শায়খুল হাদীস আল্লামা মুহাম্মদ জালালুদ্দীন আলকাদেরী (রাহ.) এর জীবনী, জন্ম, শিক্ষা জীবন, বায়াত ও দীক্ষা লাভ, শিক্ষকবৃন্দ, দাম্পত্য জীবন, মুবাল্লিগ, শ্রেষ্ঠ খতিব, লেখনী ও প্রকাশনা, ইন্তেকাল - Biography of Shaykhul Hadith Allama Muhammad Jalaluddin Al Qaderi (Rah.)

Join Telegram for More Books

 

প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন, আশেকে রাসূল (দ.) শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ আলেম মুবাল্লেগে ইসলাম, খতীবে বাঙ্গাল, মুফতিয়ে আজম, শায়খুল হাদীস, অধ্যক্ষ আল্লামা মুহাম্মদ জালালুদ্দীন আল্কাদেরী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি সুন্নী জামায়াতের জন্য এক অনন্য নিয়ামত। যিনি কর্ম ও সাধনায় নিজের জীবনকে আলোকময় করেছেন। মানুষের মাঝে ইশকে রাসূলের প্লাবন সৃষ্টি করেছেন। আহলে বায়তে রাসূল-এর প্রেম প্রীতি শিখিয়েছেন। মসলকে আ’লা হযরতকে ধারণ করে সঠিক আক্বীদা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের বীজ বপন করেছেন কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে। আল্লাহ্র প্রতি অগাধ বিশ্বাস, নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি শর্তহীন প্রেম, ভালোবাসা মানব হৃদয়কে কতটুকু দামী করতে পারে তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আল্লামা মুহাম্মদ জালালুদ্দীন আল্কাদেরী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি। কর্ম ও সাধনার ব্যাপারে আল্লাহ্ পাক ইরশাদ করেন-

مَنْ عمل صالحًا من ذكر او انثى وهو مؤمن فلنحيينّّه حيوةً طيبة ولنجز ينّه اجرَهُمْ باحَسن ما كانوا يعملون- (سورة النحل: ১৭)

অর্থাৎ যে সৎ কাজ করে পুরুষ হোক বা নারী যদি সে আল্লাহ্ ও রাসূলের প্রতি পূর্ণ বিশ্বাসী হয়, তাকে উত্তম জীবন দান করব এবং পরকালেও তাকে সৎ কাজের জন্য উত্তম বিনিময় দান করব। [সূরা নহল: আয়াত ১৭] মূলত কর্ম ও সাধনায় তিনি জীবনকে উজ্জ্বলময় করেছেন যা আল্লাহ্ পাকের অন্যতম নিয়ামত এবং সরকারে দু’জাহান নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর নজরে করম ছাড়া আর কিছুই নয়। যাদের অন্তরে খোদাভীতি, নবীপ্রেম, ওলীপ্রেম থাকবে তারা সফল হবে সব ক্ষেত্রে এর উৎকৃষ্ট প্রমাণ আল্লামা জালালুদ্দীন আল্কাদেরী। যিনি জীবনে পেয়েছেন উন্নত জীবন আর মরনেও হয়েছেন স্মরণীয়, যার প্রমাণ মৃত্যু পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ। আল্লাহ্ পাক রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেছেন-

انما يخشى الله من عباده العلماء-

অর্থাৎ নিশ্চয়ই আলেমরাই বান্দাদের মধ্যে আল্লাহ্ পাককে ভয় করেন। যার কারণে এসব আলেম মৃত্যুর পরেও অমর সম্মানিত। এমন এক ব্যক্তিত্ব আল্লামা মুহাম্মদ জালালুদ্দীন আল্কাদেরী। নবীপ্রেম, আহলে বায়তে রাসূল (দ.)-এর ভালোবাসা ও আউলিয়ায়ে কেরামের মুহাব্বত দ্বারা মানুষের মন জাগ্রত করাই ছিল তাঁর মিশন। এতে তিনি সফল হয়েছেন। কর্ম ও সাধনার এক কীর্তিমান মানুষ তাঁর সৃজনশীলতায় অনন্তকাল বেঁচে থাকবেন আশেকে রাসূলদের হৃদয়ে। পাক ভারত উপমহাদেশ ও বাংলাদেশে অসংখ্য পীর দরবেশের আবির্ভাব হয়েছে যাঁরা আল্লাহ্র উলুহিয়্যাত প্রচার ও প্রসার, নবী প্রেম ও শানে মুস্তাফার ইশায়াতে নিবেদিত ছিলেন।


আর যারা কিয়ামত পর্যন্ত এ প্রক্রিয়া ও ধারাবাহিকতা রক্ষা করবেন তাদের মধ্যে আল্লামা মুহাম্মদ জালালুদ্দীন আল্কাদেরী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি-এর নাম উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। যিনি বাতিলের বিরুদ্ধে সারা জীবন সোচ্চার ছিলেন। নবী ও ওলীপ্রেমে উজ্জীবিত ছিলেন। সুন্নীয়তের প্রচার প্রকাশনায় ছিলেন ব্যস্ত। জন্মই তাঁর সুন্নীয়তের জন্য, মৃত্যুও তার মসলকে আ’লা হযরতের জন্য। তাই তিনি চিরঞ্জীব হয়ে থাকবেন। তাঁর জীবনের চুম্বক অংশ তুলে ধরার চেষ্টা করছি।


জন্ম

বিশ্ববরেণ্য আলেমে দ্বীন, বিশিষ্ট ইসলামী শিক্ষাবিদ, দক্ষ প্রশাসক, অনলবর্ষী বক্তা, খতীবে বাঙ্গাল, ফকীহে আহলে সুন্নাত, শায়খুল হাদীস, অগণিত আলিম ফকীহ, মুহাদ্দিস, ইমাম-খতীবের উস্তাদ, শ্রেষ্ঠ ইসলামী দার্শনিক শ্রদ্ধেয় উস্তাদ আল্লামা মুহাম্মদ জালালুদ্দীন আল্কাদেরী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি পটিয়া থানার অন্তর্গত চরকানাই গ্রামের চৌধুরী পাড়ার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দের ২৯ জুলাই সোমবার এক শুভ মুহূর্তে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মরহুম আলহাজ্ব ওলী আহমদ চৌধুরী ও মাতা মরহুমা আলহাজ্ব ছুফিয়া খাতুন। তাঁরা অত্যন্ত মুত্তাকী ও পরহেজগার ছিলেন। ৪ ভাই ও ৪ বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয় ও ভাইদের মধ্যে দ্বিতীয় সন্তান ছিলেন।

ছোটকাল থেকেই নম্র, ভদ্র, বিনয়ী, মুত্তাকী এবং সবার প্রিয় ও আদরের ছিলেন। মায়ের নয়নের মনি ছিলেন। আত্মীয়-স্বজন ও স্থানীয়রা খুবই আদর করতেন। সর্বদা তাদের নজর ও দু’আয় ছিলেন।


শিক্ষা জীবন

অনন্য প্রতিভাধর এ ব্যক্তিত্ব ছোট বয়সে পারিবারিক পরিবেশে ধর্মীয় শিক্ষা লাভ করেন। পিতা-মাতার তত্ত্বাবধানে বাল্য অবস্থায় পবিত্র ক্বোরআন মজীদের দরস নেন। এবং স্থানীয় চরকানাই সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ৩য় শ্রেণি পর্যন্ত লেখা-পড়া করেন। অতঃপর তাঁর বড় ভগ্নিপতি আলহাজ্ব মাওলানা মুহাম্মদ আজিজুর রহমান মুনীরী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি তাঁকে ১৯৫৩ সালে চকবাজার কাতালগঞ্জ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি করান, সেখানে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত লেখা-পড়া করেন। ১৯৫৮ সালে হুজুর কিব্লা হাফেজ ক্বারী সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ ছিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বার্মা (মিয়ানমার) হয়ে জামেয়াতে তাশরীফ আনলে মাওলানা জালালুদ্দীন রাহমাতুল্লাহি আলায়হি তাঁর ভগ্নিপতিসহ হুজুরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। হুযূর কিবলা রাহমাতুল্লাহি আলায়হি-এর দু’আ নিয়ে জামেয়া মাদ্রাসায় জমাতে ইয়াজদাহুমে ভর্তি হন। এভাবে ইলমে দ্বীনের জ্ঞানার্জনের যাত্রা শুরু হয়। ১৯৬২ সালে অনুষ্ঠিত জামাতে হাফ্তুম কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় অংশ নিয়ে সমগ্র পাকিস্তানে ৫ম স্থান লাভ করেন। ১৯৬৪ সালে পঞ্জুম/ দাখিল, ১৯৬৬ সালে আলিম পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করে মেধা তালিকায় স্থান সহ কৃতিত্বের সার্থে উত্তীর্ণ হন।


১৯৬৬ সালে চট্টগ্রাম দারুল উলুম আলীয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে- ১৯৬৮ সালে ফাযিল ও ১৯৭০ সালে কামিল হাদীস শাস্ত্রে কৃতিত্বের সাথে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৭২ সালে বিখ্যাত দ্বীনি প্রতিষ্ঠান ছারছিনা দারুস্ সুন্নাত আলীয়া (বরিশাল) হতে কামিল ফিকহ শাস্ত্রে সারা দেশে ১ম শ্রেণিতে ২য় হয়ে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন। পাশাপাশি সাতকানিয়া কলেজ থেকে অংশ গ্রহণ করে ডিগ্রি (বি.এ) পাশ করেন।


ত্বরীকতের বায়াত ও দীক্ষা লাভ

একজন কামিল ওলীর সংস্পর্শ ও আধ্যাত্মিক উন্নতি ছাড়া মানুষের জীবন পরিপূর্ণ হয় না, তা উপলব্ধি করতেন আল্লামা জালালুদ্দীন আল্কাদেরী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি। সে সময়ে বাংলার জমীনে ত্বরীকতের আলোকধারা প্রজ্জ্বল্যমান ছিলেন হুযূর আল্লামা সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি-এর তাওয়াজ্জুহ প্রাপ্ত সাহেবজাদা মাদরজাত ওলী আওলাদে রাসূল (দ.) হযরত হাফেজ ক্বারী সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি। যার তেজোদীপ্ত রূহানী তাওয়াজ্জুহ সব খানে বিকরিত হচ্ছিল। সেই ১৯৬৪ সালে মাওলানা জালালুদ্দীন জামাতে পঞ্জুম পড়াবস্থায় আন্দরকিল্লাস্থ দৈনিক আজাদী পত্রিকার কোহিনুর প্রেসের উপর তলায় মুর্শিদে করিমের হাতে বায়াত গ্রহণ করে ত্বরীকায়ে কাদেরীয়ায় অন্তর্ভুক্ত হন। অর্থাৎ শায়খ আবদুল কাদের জিলানী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি ত্বরীকায় নিজেকে সম্পৃক্ততা করেন। আল্হামদুলিল্লাহ।


এ ত্বরীকায় আসার সাথে সাথেই তিনি সর্বত্রই সম্মানিত ও উজ্জ্বল্যমান হতে থাকেন। তাঁর নিরহংকার মনোভাব, খুলুসিয়াত, আমল, সুন্দর আখলাক দরবার শরীফের অন্যদের চেয়ে আলাদা হিসেবে বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। তার রিয়াজত, দরবারের অজিফা আদায়, পীর ভক্তি সর্বোচ্চ পর্যায়ে ছিল। এতে তিনি আপন পীরের রূহানিয়াত অর্জন করে জীবনকে আলোকময় করে তোলেন। তিনি মক্কা মোর্কারামার শায়খুত ত্বরীকত হযরত আল্লামা সৈয়্যদ আলভী মালেকী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি, কুয়েতের বিখ্যাত শায়খ হাশেম রিফায়ী ও রাঙ্গুনীয়ার হযরত আল্লামা নুরুচ্ছা নাঈমী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি থেকে ফুয়ুজাত সহ ইলমে হাদীসের সনদ লাভ করেন।


খতীবে বাঙ্গালের উল্লেখযোগ্য শিক্ষকবৃন্দ

দ্বীনের শিক্ষা অর্জনে হুজুর আল্লামা মুহাম্মদ জালালুদ্দীন আলকাদেরী সময়ের শ্রেষ্ঠ আলেম ও বুযুর্গদের সান্নিধ্য লাভ করেন। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন-


১. হযরতুল আল্লামা আহমদ সাঈদ কাযেমী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি- পাকিস্তান, ২. হযরতুল আল্লামা মুফতি আহমদ ইয়ার খান নঈমী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি- পাকিস্তান, ৩. হযতুল আল্লামা মুফতি মুহাম্মদ আমিন রাহমাতুল্লাহি আলায়হি- বাংলাদেশ, ৪. হযরতুল আল্লামা মুফতি ওয়াকার উদ্দীন রাহমাতুল্লাহি আলায়হি- পাকিস্তান, ৫. হযরতুল আল্লামা মুহাম্মদ ফোরকান রাহমাতুল্লাহি আলায়হি- বাংলাদেশ, ৬. হযরতুল আল্লামা মুফতি মোজাফ্ফর আহমদ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি, ৭. হযরতুল আল্লামা মুহাম্মদ জয়নুল আবেদীন রাহমাতুল্লাহি আলায়হি (কুমিল্লা হুজুর), ৮. হযরতুল আল্লামা আহমদুল হক রাহমাতুল্লাহি আলায়হি, ৯. হযরতুল আল্লামা মুহাম্মদ আবদুল আউয়াল ফোরকানী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি, ১০. হযরতুল আল্লামা শফিকুল ইসলাম রাহমাতুল্লাহি আলায়হি, ১১. হযরতুল আল্লামা মুহাম্মদ আবদুল গফুর নোমানী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি, ১২. হযরতুল আল্লামা মুহাম্মদ মোছলেহ উদ্দীন রাহমাতুল্লাহি আলায়হি, ১৩. হযরতুল্ আল্লামা মুহাম্মদ ইসমাঈল আরকানী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি, ১৪. হযরতুল আল্লামা মুহাম্মদ আবুল কাশেম উদ্দীন রাহমাতুল্লাহি আলায়হি, ১৫. হযরতুল আল্লামা মুহাম্মদ নিয়ায মাখদুম আল্ খাত্তানী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি, ১৬. হযরতুল আল্লামা মুহাম্মদ আবদুল করিম রাহমাতুল্লাহি আলায়হি, ১৭. হযরতুল আল্লামা মুহাম্মদ সাইফুর রহমান (মু.জি.)।

[তথ্য সূত্র: অধ্যক্ষ আল্লামা জালালুদ্দীন আল্কাদেরী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি: একটি বিস্ময়কর প্রতিভা, পৃষ্ঠা ১৮-২৩]


দাম্পত্য জীবন

জামেয়া আহমদিয়া স্ন্নুীয়া আলীয়ার মুহাদ্দিস থাকা অবস্থায় মা-বাবার প্রস্তাবে পাটিয়ার রশিদাবাদ (শোভনদণ্ডী)’র ইউনিয়ন চেয়ারম্যান (তৎকালীন) আল্লামা সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ ছিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি-এর বিশিষ্ট মুরিদ, চট্টগ্রাম স্টার জুয়েলার্স ও আল্ হেলাল বোডিং এর মালিক আল্হাজ্ব আহমদ হোসেন চৌধুরীর প্রথম কন্যা বেগম খুরশীদ জাহান-এর সাথে শাদীয়ে মুবারক সম্পন্ন হয়। দাম্পত্য জীবনে তাঁদের ৫ কন্যা ও ২ সন্তান রয়েছে। তাঁর জীবদ্দশায় ৫ মেয়ে ও ১ পুত্রের বিবাহ সম্পন্ন হয়। বড় ছেলে ব্যারিস্টার আবু সায়িদ মুহাম্মদ কাশেম সুপ্রিম কোর্টে আইন পেশায় নিয়েজিত। এবং প্রখ্যাত আইনবিদ ড. কামাল হোসেনের অ্যাসোসিয়েট হিসেবে কর্মরত। ছোট ছেলে সায়িদ হামেন উচ্চতর শিক্ষায় নিয়েজিত আছেন। মেয়েরাও নিজ নিজ পরিবার নিয়ে ভাল অবস্থানে আছেন। তাঁর ৪ ভাই ও ৪ বোনের মধ্যে কেবল ছোট ভাই অধ্যাপক মমতাজ উদ্দীন চৌধুরী ও ২ বোন জীবিত আছেন।


মুবাল্লিগে ইসলাম হিসেবে দায়িত্ব পালন

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী তাঁর পীরের নির্দেশে চট্টগ্রাম জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলীয়ায় মুহাদ্দিস পদে যোগদান করেন এবং সুনামের সাথে দীর্ঘ ৮ বছর হাদীস বিভাগে অধ্যাপনা করেন। তখন তিনি অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিসে পরিণত হন এবং হাদীস শাস্ত্রে পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। দেশ-বিদেশে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে থাকেন। পাশাপাশি তিনি মুবাল্লিগে দ্বীনের দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। তিনি অনলবর্ষী বক্তা ফখরে মিল্লাত, মুনাযিরে আহলে সুন্নাত, খতীব ও ওয়ায়িযে খোশ বয়ান রূপে সমাদৃত হতে থাকেন। সুন্নী জনতার নয়নমনি, আক্বায়িদে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের মুখপাত্রের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি দরবারের পাশাপাশি দায়িত্বও আঞ্জাম দেন। পীরের নির্দেশে ১৯৮০-৮১ সালে উপাধ্যক্ষ ও ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮১ সালে অধ্যক্ষ পদে আসীন হন। তাঁর সময়কালে জামেয়াকে দেশের শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলেন। শিক্ষকতায় পারদর্শিতা, প্রশাসনিক দক্ষতা ও আর্থিক ক্ষেত্রে স্বচ্ছলতার জন্য তিনি ২০১১ ও ২০১৪ সালে দেশের ‘‘শ্রেষ্ঠ অধ্যক্ষ’’-এর খ্যাতি অর্জন করে স্বর্ণ পদক লাভ করেন। তাঁর দক্ষ পরিচালনায় জামেয়াও দেশের শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত হয়।


মাদ্রাসার অধ্যক্ষ পদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন সহ তিনি মাজহাব ও মিল্লাতের দ্বীনি দায়িত্ব পালন করে গেছেন বিরতিহীনভাবে। বাতিল মাজহাব ও আক্বিদার বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন বজ্রকন্ঠ। মসলকে ‘আ’লা হযরত’ হযরত আহমদ রেযা খান ফাজেলে বেরলভীর সুন্নীয়ত দর্শন প্রচার ও প্রসারে তিনি ছিলেন অগ্রগণ্য। তিনি ছিলেন সুন্নীয়ত আকাশের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। মৃত্যুর সময় পর্যন্ত তিনি আহলে সুন্নতের আক্বিদা প্রচার ও প্রসারে লিপ্ত ছিলেন।


খেতাবের দায়িত্ব ও যুগের শ্রেষ্ঠ খতিব

আল্লামা মুহাম্মদ জালালুদ্দিন ১৯৭৯ সাল থেকে চট্টগ্রাম শহরের প্রসিদ্ধ মসজিদ খাতুনগঞ্জের হামিদুল্লাহ্ খান জামে মসজিদে দীর্ঘ সময় ধরে খতিবের দায়িত্ব পালন করে গেছেন।


১৯৮৭ সালে ‘জমিয়তুল ফালাহ্’ জাতীয় মসজিদের খতিব নিযুক্ত হন। ইন্তেকালের পূর্ব পর্যন্ত তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয়, দক্ষ ও সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য যুগশ্রেষ্ঠ আলিমেদ্বীন হিসেবে খতিব পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।


উল্লেখ্য, হুজুর ছাত্রাবস্থা থেকে মসজিদে খেতাবত করতেন। তিনি ১৯৬৮ সাল থেকে চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশন কলোনি জামে মসজিদে, অতঃপর আগ্রাবাদ সিজিও অর্থাৎ সেন্ট্রাল গভর্ণমেন্ট অফিসার্স কলোনি জামে মসজিদে ও আগ্রাবাদ জাম্বরী মাঠ জামে মসজিদেও খেতাবত ও জুমার দায়িত্ব পালন করেন। জুমার খোতবা পূর্ব হুজুরের ‘ধর্মীয় বয়ান’ যেন মুসল্লিদের সারা সপ্তাহের ঈমান বুদ্ধির নিয়ামক হিসেবে কাজ করত। দূর দূরান্ত, গ্রাম-গঞ্জ থেকে জমিয়তুল ফালাহ্-ই তাঁর বক্তব্য ও রূহানী বয়ান শোনার জন্য মানুষ ছুটে আসত। মসজিদে তিল ধারনের স্থান পাওয়া যেতো না। মনমুগ্ধকর এক ধর্মীয় পরিবেশে হুজুরের রূহানী-ঈমানী বয়ান সমবেত মুসল্লিদেরকে ধর্মের পক্ষে উদ্বুদ্ধ করে দ্বিগুণ হারে ধাবিত করত।


যুগের একজন শ্রেষ্ঠ আলেম শতাব্দীর একজন শ্রেষ্ঠ দার্শনিক হয়ে সুন্নী মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা করেছেন বাংলার জমীনে বিভেদ নয় সংঘাত নয় যুক্তি দিয়ে আক্বিদার বয়ান দিতেন। ভাষার ব্যবহার, বাচন ভঙ্গি ও যুক্তির অকাট্যতা, সর্বোপরি অপরের প্রতি সম্মানবোধ তাঁকে অনেক উচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠা করেছেন। কিয়ামত পর্যন্ত সুন্নীয়ত প্রতিষ্ঠার যুদ্ধে যারা থাকবেন তারা তাঁকে অগ্রগামী একজন পথ প্রদর্শক হিসেবে মান্য করে যাবে নিঃসন্দেহে। তাঁর মুগ্ধতায় ছিলেন প্রশাসনের সর্বস্তরের কর্মকর্তা, পীর, আলেম-ওলামা বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিকসহ সর্বস্তরের জনগণ। কেননা ধর্মের বিষয়ে যৌক্তিক, সুন্দর ও বিভেদহীন পরামর্শ তাঁর কাছেই পাওয়া যেতো। তিনিই ছিলেন- সুন্নীয়তের প্রতীক ও আশার স্থল।


ফতোয়া প্রদান ও আক্বিদা বিষয়ক লেখনী ও প্রকাশনা

আল্লামা জালালুদ্দীন আলকাদেরী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি জামেয়া আহমদিয়া সুন্নীয়ার প্রতিষ্ঠিত ‘ফতোয়া বিভাগ’-এর চেয়ারম্যান হিসেবে দেশ-বিদেশের যাবতীয় শরয়ী বিষয়ের উপর উত্থাপিত বিষয়াবলীর সমাধান দিতেন। এ ছাড়া ফারায়েযা, মানুষের জীবনের বিভিন্ন সমস্যাবলীর উপর সুন্দর সুন্দর সুরাহা ও ফতোয়া দিতেন। তাঁর ফতোয়ার সংকলন কাজ চলছে। ইন্শাআল্লাহ্ অচিরেই তা ‘আল্লামা জালালুদ্দীন ফাউণ্ডেশন’ থেকে প্রকাশিত হবে। যা মুসলিম মিল্লাতের রূহানী খোরাক হয়ে থাকবে। তিনি সুন্নী আক্বিদার সকল বিষয় নিয়ে লিখেছেন, রেডিও, টিভি, সেমিনার, সেম্পোজিয়ামসহ দেশ-বিদেশে আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে বক্তব্য রেখেছেন। তাঁর লিখিত দরসে ক্বোরআনুল করীম (দুই খণ্ডে) বাজারে রয়েছে। যেখানে তিনি আক্বিদা বিষয়ক বিষয়াবলীর সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন। মূলত সুন্নী আক্বিদা বিষয়ক লেখা তৈরি, পরিশীলন ও বিভিন্ন বিষয় শারয়ী সমাধানে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতেন। তিনি আনজুমান ট্রাস্ট কর্তৃক প্রকাশিত মাসিক তরজুমান-এ আহলে সুন্নাত-এর ১৯৭৯ সালে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক এবং ১৯৮১ সাল থেকে সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে সুন্নী আক্বিদার বিস্তারে ব্যাপক অবদান রাখেন।


সংগঠক হিসেবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অবদান

যুগের একজন শ্রেষ্ঠ আলেম, সংগঠক এবং একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি হিসেবে হুজুর আল্লামা জালালুদ্দীন আলকাদেরী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র অবস্থান সবার উর্ধ্বে, সর্বজন সম্মানিত। দায়িত্বশীলতা ও বিবেচনাবোধ, সহনশীলতা, পরোপকারিতা, সর্বোপরি সর্বজন গ্রহণযোগ্যতা, তাঁকে সর্বোচ্চ স্থানে আসীন করেছিলো সর্বস্তরের মানুষ। যার কারণে তিনি বিভিন্ন সামাজিক, দ্বীনি, আক্বিদানির্ভর প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি ইসলামিক ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশ-এর সম্মানিত গভর্ণর, খতিব সমিতি বাংলাদেশের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। আমৃত্যু। তিনি মাদ্রাসা শিক্ষকদের পেশাজীবী সংগঠন ‘জমিয়তুল মোদাররেসিন’ চট্টগ্রাম জেলার সভাপতিও ছিলেন।


আহলে বায়তে রাসূল (দ.)-এর প্রেম মুসলিম মিল্লাতের মনে বিস্তারের জন্য তিনি আজীবন কাজ করেছেন। জমিয়তুল ফালাহ্ জাতীয় মসজিদে ৩১ বছরে ধরে শাহাদাতে কারবালা মাহফিল প্রতিষ্ঠা করে দ্বীন-ধর্মের বিস্তৃতি ঘটিয়েছেন।


সুন্নীয়তের সঠিক আক্বিদা ‘আক্বায়েদে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত’ প্রচারের জন্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। পাকিস্তান, ভারত, মিয়ানমার, ইরাক, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, কুয়েত, কাতার, ওমান, সাউদি আরব, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বহুবার সফর করেছেন এবং সে সব দেশে সুন্নীয়তের মতাদর্শ ভিত্তিক সংগঠন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেছেন। যার কর্মকাণ্ড সবদেশেই বিস্তৃত রয়েছে। ইতিমধ্যে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধিরা আল্লামা জালালুদ্দীন ফাউণ্ডেশন-এর কর্মকর্তাদের সাথে সংযোগ রেখে চলেছেন। এবং এসব দেশের দায়িত্বশীল প্রতিনিধিরা দেশে সফর করে হুজুরের মাজার যিয়ারত করে গেছেন। আশা করি ভবিষ্যতে এ ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে।

ইন্তেকাল ও স্মরণকালের বৃহত্তম জানাজা

জন্মালে মরতে হয়। আর যাদের জীবন মানবতার জন্য আশীর্বাদ, তাদের মৃত্যু ও মানবতার জন্য এক পরীক্ষা। ক্ষণজন্মা এসব মহাপুরুষ তাদের জীবদ্দশায় মানবতার উদ্দেশ্যকে সাধন করেন আর মৃত্যুর পর মওলায়ে হাক্বিকায় নিয়ামতে আনন্দিত থাকেন। যার কারণে তাদের মৃত্যুটাই বড় নিয়ামত। যে জীবন এশকে রাসূল, এশকে ওলী, এশকে আহলে বায়তে ছিল, সে জীবন কেমনে এমন ব্যক্তিকে সম্মানিত করবেনা। মৃত্যুও তাকে সম্মানিত করেছে। দ্বীনের জলসায় উপস্থিত রেখে আল্লাহ্ পাক যাদেরকে সম্মানিত করেন, তাদেরকে এমন নিয়ামত দেন, যার বর্ণনা দিয়ে শেষ হবে না। আল্লামা মুহাম্মদ জালালুদ্দীন আলকাদেরী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি এমন এক তব্কার ওলী যাকে হযরাতে কিরাম কবুল করেছেন। তাই তিনি ইন্তেকালের পরও মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত সম্মানিত, কিয়ামত পর্যন্ত এ ধারাবাহিকতা চলতে থাকবে।


আল্লামা জালালুদ্দীন আল্কাদেরী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি ২০১৬ সালের ২৬ নভেম্বর ঢাকায় আ’লা হযরত কনফারেন্স-এর সভাপতিত্ব করছিলেন। হঠাৎ অসুস্থতা বোধ করলেন। সে অনুষ্ঠানের দ্বীনি তাজকারায় তিনি এ জগতের বন্ধন ছিন্ন করে চিরবিদায় নেন। ঢাকায় তাঁর পীরের প্রতিষ্ঠিত দ্বীনি ইদারা ‘ঢাকা কাদেরিয়া আলীয়া, ঢাকা বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ, চট্টগ্রাম জমিয়তুল ফালাহ্ জাতীয় মসজিদ ও জামেয়া আহমদিয়া সুন্নীয়া আলীয়া মাদ্রাসায় সর্বমোট ৪টি জানাযা শেষে মাদ্রাসা সংলগ্ন পারিবারিক কবর স্থানে মা-বাবার পাশে চিরশায়িত হন।


লক্ষ লক্ষ সুন্নী জনতা আশেকে রাসূলের উপস্থিতিতে তাঁর জানাজায় ছিল এক অভাবণীয় দৃশ্য। স্মরণকালের বৃহত্তম জানাজা। বিশ্ব মিডিয়া যার প্রচার করেছে। সম্মানিত মানুষদেরকে আল্লাহ্পাক এভাবে ইজ্জত দিয়ে থাকেন।


শেষ কথা

সত্যিকার আলেমদের ইন্তিকালে পৃথিবীর মৃত্যু হয়। আল্লামা মুহাম্মদ জালালুদ্দীন আলকাদেরী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি-এর মৃত্যুর পরবর্তী সুন্নী জনতার হাহাকার সে বাস্তবতাকে প্রমাণ করেছে। জালালুদ্দীন আলকাদেরী শুধু ব্যক্তি নন বরং একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছেন।


এ প্রতিষ্ঠানকে টিকিয়ে রাখার জন্য তাঁর আদর্শকে ধারণ করা ও সর্বস্তরে বিস্তার করার বিকল্প নেই। তাঁর লেখনি, বক্তব্য ওয়াজ, পরামর্শ, চিন্তাধারা ভাষ্য, প্রজন্মদের কাছে পৌঁছাতে হবে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তার খিদমত ও চিন্তাধারার বিকাশ তারই প্রতিষ্ঠিত সাংগঠনিক কাঠামো দিয়ে বিস্তৃত করার বিকল্প নেই। পারস্পরিক রেষারেষি, হিংসা-বিদ্বেষ ইত্যাদির উর্ধ্বে উঠে তাঁর চিন্তাধারা বিকশতি করা সময়ের দাবী।

আল্লাহ্ পাক রাব্বুল আলামীন তাঁর খিদমতগুলো কবুল করুন। আ-মী-ন ছুম্মা আ-মী-ন।

Tags

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Ok, Go it!