বাংলায় মুসলিম সভ্যতা ও ঐতিহ্য - মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল করিম
৯৩ হিজরি, ৭১২ খৃস্টাব্দ। মুহাম্মদ বিন কাসিম কর্তৃক সিন্ধুবিজয় ছিল বাংলায় মুসলিম সভ্যতার উন্মেষকাল। আরব বণিক, পীরদরবেশ ও মুসলিম বিজেতাদের আগমনপর্ব এ দেশে ইসলামি ভাবধারার গোড়াপত্তন করে।
হিজরি ৫৯৯ সাল। বাংলায় মুসলিম আধিপত্যের মাহেন্দ্রক্ষণ। ইংরেজি হিসেবে ১২০২ মতান্তরে ১২০৪ খৃস্টাব্দ। মুহাম্মদ ঘুরীর ভারত প্রতিনিধি কুতুব উদ্দীন আইবেকের সুযোগ্য, তেজস্বী এবং তরুণ সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজির রণনৈপুণ্যে বিনাযুদ্ধে বাংলা মুসলমানদের হাতে বিজয়। বিজয়ের পর বখতিয়ার খলজি প্রতিষ্ঠা করেন মসজিদ, মাদরাসা ও দরবেশগণের জন্য সরাইখানা।(১)' তবে এর আগথেকেও এ দেশে ইসলামের পয়গাম ঘুরে বেড়িয়েছিল মর্মে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। শাহ সুলতান মাহমুদ বলখি মাহিসাওয়ার (রহ.)-এর আগমন খলজির বাংলা বিজয়ের পূর্বে। তুর্কিস্তানের বলখ রাজ্যের সুলতান ছিলন তিনি। ৩৬ বছর কঠোর সাধনায় সিদ্ধিলাভের পর ইসলাম প্রচারকল্পে সমুদ্রপথে বাংলায় আসেন এ মহান বুজুর্গ। বাংলার বিভিন্ন জায়গায় ইসলাম প্রচার করে বগুড়ার মহাস্থানগড় এলাকায় এসে তৈরি করেন খানকাহ।(২) ইসলাম প্রচারের গুরুদায়িত্ব পালনকারী শাহ সুলতান বলখির (রহ.) সমকালীন আরেকজন দরবেশের তথ্য পাওয়া যায়। বর্তমান নেত্রকোণার মদনপুরের শাহ সুলতান রুমি (রহ.)। রুমের রাজত্ব ছেড়ে বাংলায় আসেন ইসলামের পয়গাম নিয়ে।(৩) ১১৭৯ খৃস্টাব্দে বিক্রমপুরে আগমনকারী বিস্ময়কর ও চমকপ্রদ কিংবদন্তী হযরত বাবা আদম শহিদ (রহ.)।
এভাবে বিভিন্ন প্রেক্ষাপট, স্মৃতিফলক, শিলালিপি এবং মুসলিম স্থাপনা বাংলাদেশে হিজরির প্রথম শতক থেকে ইসলামের আগমনের সাক্ষ্য বহন করে আসছে। আরবভূমি, ওমান, ইয়ামেন, রুম, বুখারা সহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সাধকপুরুষরা ইসলামের নির্মল বার্তা নিয়ে এ দেশে পাড়ি জমান। কেউ জলপথে, কেউ স্থলপথে। কেউ একা, কেউ সদলবলে। জলপথ পাড়ি দিয়ে বাংলার প্রবেশদ্বার ছিল চট্টগ্রাম। আর স্থলপথে সিলেট, পশ্চিমবঙ্গ, গৌড় ও পাণ্ডুয়া। তাঁদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও আত্মনিয়োগের ফলে তাঁদের মহান আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে দলেদলে মানুষ দীক্ষিত হয় ইসলামের সুশীতল ছায়ায়। বাংলার প্রত্যন্তাঞ্চলে গড়ে উঠে মুসলিম জনবসতি। কালেকালে জন্ম নেয় ইসলামি সভ্যতা। মুসলিম সভ্যতার স্মারক হিসেবে এখনো মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাংলার অপরিমেয় স্থাপনা ঐতিহ্য।
মুসলিম স্থাপত্যশিল্প :
বাংলায় মুসলিম সভ্যতার প্রাচীন নিদর্শনাবলির অনন্য ফলক হিসেবে স্থাপত্যশৈলী আজো কালক্ষেপণ করে যাচ্ছে। বাংলার মুসলিম স্থাপত্য প্রধানত দুটি ধারায় বিভক্ত।
যথা
ক. সুলতানি স্থাপত্য
খ. মুঘল স্থাপত্য
ক. সুলতানি স্থাপত্য : ১২০৪-১৫৭৬ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত নির্মিত স্থাপনা সুলতানি আমলের আওতাভুক্ত। সুলতানি বাংলার স্থাপত্যকলার নিদর্শন হিসেবে উল্লেখযোগ্য হলো-
- আদিনা জামে মসজিদ ( ১৩৭৫ খৃ.), পাণ্ডুয়া ।
- গুণমত মসজিদ, গৌড়।
- দরসবাড়ি মসজিদ, গৌড় ।
- গোয়ালদিঘী মসজিদ, সোনারগাঁও, ঢাকা।
- মোল্লাসিমলা মসজিদ, শ্রীরামপুর, হুগলি।
- চেহেলগাজী মসজিদ (১৪৬০ খৃ.), দিনাজপুর।
- রোকন খান জামে মসজিদ (১৫১২ খৃ.), দিনাজপুর। প্রভৃতি।(৪)
খ. মুঘল স্থাপত্য : ১৫৭৬-১৭৫৭ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত নির্মিত স্থাপনাদি মুঘল স্থাপত্যের অন্তর্ভুক্ত। মুঘলদের স্থাপত্যকলা অভিনবত্বপূর্ণ। সুলতানি আমলের কারুকার্যখচিত স্থাপত্যকে নূতন আঙিকে ঢেলে সাজিয়ে স্থাপত্যকর্মে নতুন জোয়ার সৃষ্টি করেছেন মুঘলরা। শৈল্পিক হাতের পারশে বেড়ে উঠেছে সবকটি মুঘলস্থাপত্য। পোড়ামাটির ফলকের অলংকরণের জায়গায় মুঘলরা পলেস্তার ব্যবহার করতো। এ সময়ের মসজিদ নির্মাণ স্থাপত্যে ছাদ কিনারা সমতল আকার ধারণ করে। তবে প্রত্যন্তাঞ্চলে কিছুকিছু ধনুকবক্র ছাদের নমুনা পাওয়া যায়। বগুড়ার শেরপুরের মুরাদ খান কাকশাল কর্তৃক নির্মিত খেরুয়া মসজিদ মুঘল আমলের ধনুকবক্র ছাদের নজির স্থাপন করে। বাংলার স্থাপত্যে দ্বিগম্বুজ প্রচলনের কোনো প্রমাণ পাওয়া না গেলেও মুঘলরা দ্বিগম্বুজের অনুকরণে মিনার নির্মাণে শৈল্পিকতা এনেছেন।(৫)
প্রাচীন শিলালিপি :
বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখানকার ধর্মপ্রাণ জনগোষ্ঠীর অসংখ্য নিদর্শন হিসেবে শিলালিপি পাওয়া যায়। এসব শিলালিপিতে মুসলিম শাসক ও সুফি-দরবেশগণের নাম, জীবনবৃত্তান্ত, সময়কালসহ ঐশীগ্রন্থ আল-কুরআনের বিভিন্ন আয়াত ও হাদিসে নববির মুক্তোঝরা বাণী খোদিত আকারে পাওয়া যায়। এসব শিলালিপির সাহায্যে উন্মোচিত হয়েছে বাংলায় হাজার বছরের মুসলিম ঐতিহ্য। উত্তর-পূর্ব বাংলায় ইসলামি জাগরণের মহানায়ক হযরত শাহজালাল (রহ) কর্তৃক সিলেট বিজয়ের তারিখ বহনকারী স্মৃতিফলকটি এখনো জাতীয় যাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।(৬) এভাবে সুলতানি ও মুঘল শাসনামলের আরো অসংখ্য শিলালিপি বাংলায় মুসলিম ঐতিহ্যের স্মারক হয়ে আছে, যার অধিকাংশই হয়ত মাটিচাপা, নতুবা লয়প্রাপ্ত।
ইসলামি শিক্ষাচর্চা:
বখতিয়ার খলজির হাতধরে বাংলা বিজয় পরবর্তী অসংখ্য ইসলামি শিক্ষালয়ের প্রতিষ্ঠা হয়। সোনারগাঁও-এর অন্যতম ইসলাম প্রচারক প্রখ্যাত সাধক শায়খ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামার (রহ.) হাতধরে এ দেশে সর্বপ্রথম ইসলামি শিক্ষাকেন্দ্রের অগ্রযাত্রা। এখানে নিয়মিত চলতো কুরআন, হাদিস, তাফসির, এবং ফিকহসহ ইসলামি জ্ঞানচর্চা। কালক্রমে মুসলিম বাংলায় বিভিন্ন শাসক কর্তৃক অসংখ্য মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। সুবেদার শায়েস্তা খাঁ (১৬৬৪-১৬৮০ খৃ.) ঢাকায় একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠার কথা জানা যায়। (৭)
১৭৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত কলকাতা আলিয়া মাদরাসাকে (পরে ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসা) কেন্দ্র করে এ দেশে গড়ে উঠেছে হাজার হাজার সমজাতীয় মাদরাসা। এসব মাদরাসায় বর্তমানে ইসলামি জ্ঞানবিজ্ঞানের বিভিন্নমুখী চর্চা অব্যাহত। ১৯০৭-০৮ সালে এদেশে ইবতেদায়ি হতে কামিল পর্যন্ত মাদরাসা ছিল ২, ৪৪৪টি। ১৯৪৭ সালে ৩টি সরকারি মাদরাসাসহ (দাখিল হতে কামিল পর্যন্ত) আলিয়া মাদরাসার সংখ্যা ছিল ৩৭৮টি। ১৯৭১ সালে দাখিল, আলিম, ফাযিল ও কামিল মাদরাসার সর্বমোট সংখ্যা ছিল ৫০৭৫টি। ২০০৭ সালে মাদরাসার সংখ্যা দাঁড়ায় মোট ৯,৪৯৩টিতে। তন্মধ্যে দাখিল ৬,৭০০টি, আলিম ১,৪০০টি, ফাযিল ১,০৮৬টি এবং কামিল ১৯৮টি। ১৯৮৫ সাল হতে দাখিলকে এস. এস. সি এবং আলিমকে ১৯৮৭ সাল থেকে উচ্চ মাধ্যমিক-এর সমমান সরকারীভাবে স্বীকৃত। (৮)
ধর্মীয় আচার ও পার্বণিক উৎসব :
বাংলা বিজয়ের ইতিহাসের পাশাপাশি এখানকার জনবসতিতে ইসলাম ধর্মবিশ্বাস ছড়িয়ে পড়ার কারণও সুস্পষ্ট। ফলে মুসলিম সমাজে ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসের পাশাপাশি বিভিন্ন বিধিবিধানকে কেন্দ্র করে পার্বণিক অনুষ্ঠানসমূহও যথাযথ পালিত হয়ে আসছে। নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাত সহ অন্যান্য পালনীয় শর'য়ি বৈধ কার্যক্রমও যথারীতি হয়ে আসছে। ঈদুল ফিতর, ঈদুল আহা, লাইলাতুল কদর, লাইলাতুল বরাত, শবে মি'রাজ, আশুরা, মিলাদুন্নবী (স) মাহফিল প্রভৃতি উৎসব ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যে অত্যন্ত আন্তরিক পরিবেশে উদযাপিত হয়ে আসছে। এসব উৎসব পালিত হয় চন্দ্রমাসের তারিখ হিসাবে।(৯) পীরবুজুর্গদের আস্তানা যিয়ারত ও ফাতেহাখানির আয়োজন এ বাংলায় বহুকাল ধরে। পালিত হচ্ছে হিজরি নববর্ষও।
সাহিত্য চর্চা : ইসলামি উপাদান
বাংলায় সাহিত্যচর্চা প্রাচীনকাল থেকে। সুলতানি যুগের শিক্ষিত ও সংস্কৃতিবান শাসকদের উৎসাহ-অনুপ্রেরণা বাংলা সাহিত্যের বিকাশে বিশেষ স্মরণীয়। সুলতান গিয়াসুদ্দীন আযম শাহের আমলে (১৩৮৯-১৪০৯) শাহ মুহাম্মদ সগীর (১৩৩৯ ১৪০৯) ইউসুফ জোলেখা' রচনা করেন। এটা একটি ধর্মীয় এবং রোমান্টিক কাব্য। বাংলাসাহিত্যের বিকাশ ও শ্রীবৃদ্ধির ক্ষেত্রে ইউসুফ জোলেখা কাব্যের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বাংলাভাষায় মুসলিমরাই প্রথম লৌকিক কাব্য এবং প্রণয়মূলক কাব্যের স্রষ্টা। তাদের রচনাবলিতে ইসলামি ভাবধারা ও ঐতিহ্যের প্রকাশ ঘটেছে, তেমনি মানবতাবাদী এবং রোমান্টিকতাও পরিলক্ষিত।(১০) মধ্যযুগীয় মুসলিম সাহিত্যিক হিসেবে শীতালং শাহ (১২০৭-১২৯৬), শাহ বারিদ খাঁ (১৫১৭-১৫৫০), সৈয়দ সুলতান (১৫৫০-১৬৪৮), কবি শেখ চান্দ (১৫৬০-১৬৬০), নসরুল্লাহ (১৫৬০-১৬৪৫) এবং আধুনিক যুগের মধ্যে মীর মশাররফ হোসেন (১৮৪৭-১৯১১), কবি দাদ আলী (১৮৫২-১৯৩৬), সৈয়দ ইসমাঈল হোসেন সিরাজি (১৮৮০ ১৯৩১), কায়কোবাদ (১৮৫৭-১৯৫১), গোলাম মোস্তফা (১৮৯৭-১৯৬৪), কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) সহ প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। কাব্য, গল্প, উপন্যাস, কবিতাসহ সাহিত্যের বিভিন্ন ধারায় ইসলামি চিন্তাচেতনার সমন্বয়সাধনের মাধ্যমে মুসলিম কবিসাহিত্যিকরা বাংলা সাহিত্যকে সুশোভিত করেছে। এনেছে নতুনত্ব। সাজিয়েছে অভিনবত্বে।
১. গৌড় ও পাণ্ডুয়ার স্মৃতিকথা, এম, আবিদ আলী খান মালদাহ, পৃ. ২৩।
২. বাংলাদেশের সূফী সাধক, ডক্টর গোলাম সাকলায়েন, পৃ. ৪৯-৫০
৩. ভারবর্ষের ইতিহাস, আলবেরুনি, খ. ১, পৃ. ১৩-৯৩।
৪. মুসলিম স্থাপত্য, ড. এ কে এম ইয়াকুব আলী, পৃ. ১৭৫।
৫. মুসলিম স্থাপত্য, ড. এ কে এম ইয়াকুব আলী, পৃ. ১৬৯।
৬. প্রাচ্যসূর্য হযরত শাহজালাল (রহ.), আলী মাহমুদ খান, পৃ. ৮৯।
৭. আলিয়া মাদরাসার ইতিহাস, মো. আবদুস সাত্তার, পৃ. ৩০।
৮. http://bn.banglapedia.org/index
৯. শরীয়ত নামা, নসরুল্লাহ খোন্দকার, পৃ. ১১৯।
১০. সাহিত্য পরিচয়, মাহমুদুল হাসান নিজামি, পূ. ৫৩।
মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল করিম
সাবেক সহ-সভাপতি, ফুল-ইয়ামিন ছাত্রকল্যাণ পরিষদ।