ইতিহাস রচনার উপাদান - Elements of history writing

Mohammed Ahsan



 

ইতিহাস রচনার উপাদান - Elements of history writing

ইতিহাস রচনার উপাদান

প্রাচীন ভারতের ইতিহাস চর্চা খুব সহজ নয়। সমকালে এমন কোন ইতিহাস গ্রন্থ লিখিত হয়নি যে তার উপর ভিত্তি করে ইতিহাস রচনা সহজ হবে। গ্রিস বা রোমের মতো ভারতে জন্ম হয়নি খ্যাতিমান কোন ইতিহাসবিদের যাঁরা নিজেদের সময়ের ইতিহাস লিখে রাখবেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। তাই পরবর্তীকালের ইতিহাসবিদগণকেই প্রাচীন ভারতের ইতিহাস লেখার দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়েছে। ভারতে ইতিহাসবেত্তাদের এই শূন্যতার কারণ অনুসন্ধান করেছেন ঐতিহাসিক ড: এ. বি. কীথ (A.B. Keith)। তাঁর মতে ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ঘটেনি বলে তারা জাতীয় ইতিহাস লিখতে অনুপ্রাণিত হয়নি। ভারতীয়দের বৈচিত্র্যহীন রাজনৈতিক পরিবেশ তাদের মধ্যে জাতীয়তাবোধ সৃষ্টির অন্তরায় হিসাবে কাজ করেছে। কীথ মনে করেন খ্রিস্টপূর্ব যুগে ভারতে বড় কোন বৈদেশিক আক্রমণ হয়নি বলে ভারতীয়রা জাতীয়তাবোধসম্পন্ন হয়ে উঠতে পারেনি। বিদেশী আক্রমণ যে একেবারে হয়নি তা বলা যাবে না। কারণ পারস্য সম্রাট দারায়ুসের নেতৃত্বে ভারত অভিযান পরিচালিত হয়েছিল। পরে আলেকজান্ডারের নেতৃত্বে গ্রিক আক্রমণও পরিচালিত হয়েছিল। তবে এই বিদেশী আক্রমণকারীগণ ভারতের অভ্যন্তরে বহুদূর পর্যন্ত প্রবেশ করতে পারেননি বলে জনজীবনে এর প্রভাব তেমন সুদূরপ্রসারী ছিল না। তাছাড়াও কীথ মনে করেন অদৃষ্টবাদী ভারতীয়রা ইহলৌকিক জীবনের ঘটনাবলী সংরক্ষণে তেমন উৎসাহী ছিল না। তাই তাদের পক্ষে ইতিহাস রচনায় মনোযোগী হওয়া সম্ভব হয়নি।

সার্বিক মূল্যায়ন করলে দেখা যাবে যে কীথের বিশ্লেষণে আংশিক সত্যতা থাকলেও অনেক অপূর্ণতাও ছিল। দেখা যাবে সমকালের ইতিহাস লেখার বা ঘটনাপ্রবাহ লিপিবদ্ধ করার চেষ্টা বিভিন্ন সময়েই গৃহীত হয়েছিল। তবে সন, তারিখ সংযুক্ত করে বিজ্ঞানসম্মতভাবে ইতিহাস গ্রন্থ লেখার অভিজ্ঞতা তখনও হয়নি। রাজারা প্রায়শই সভাপণ্ডিতদের দ্বারা তাদের কীর্তিকাহিনী লিপিবদ্ধ করাতেন। তাম্রশাসন বা প্রস্তর ফলকে বিজয়ের কৃতিত্ব, ধর্মীয় অনুশাসন, প্রশাসনিক বিধি-নিষেধ প্রভৃতি উৎকীর্ণ করাতেন। রাজ-রাজড়ার বা ধর্মনেতাদের জীবনীগ্রন্থ লেখার প্রথা প্রচলিত ছিল। ফলে সেখানে স্বভাবতই প্রাসঙ্গিকভাবে ইতিহাসের ঘটনা সংযুক্ত হতো। তবে এসব রচনা বা উপাত্তকে পরিপূর্ণভাবে ইতিহাস বলা যায় না। কিছু কিছু প্রাচীন গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া গেলেও তাকে সম্পূর্ণরূপে ইতিহাসের মর্যাদা দেয়া চলে না। ভারতের প্রাচীন যুগের শেষ লগ্নে দ্বাদশ শতাব্দীয় দিকে কাশ্মীরে বচিত একটি গ্রন্থকে প্রথম ইতিহাসের মর্যাদা দেয়া হয়। কাশ্মীরের ইতিহাস হিসাবে পরিচিত এই গ্রন্থটির নাম রাজতরঙ্গিণী। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে হাজার হাজার বছর আগের গ্রাচীন তারতের কথা কাহিনী পরবর্তীকালের ইতিহাসবিদদের সংগ্রহ করতে হয়েছে নানা উপাদানের ভেতর থেকে। এই উপাদানসমূহকে চিহ্নিত করা ইতিহাস পাঠ শুরুর পূর্বে সবচেযে বেশি জরুরী।

ইতিহাসের উপাদানকে গুরুত্বের বিবেচনায় দুটি প্রধান ভাগে ভাগ করা হয়। প্রথমটি গ্রাথমিক সূত্র (Primary source) এবং দ্বিতীয়টিকে বলা হয় দ্বিতীয় পর্যায়ভুক্ত সূত্র (Secondary source)। বর্তমান প্রসঙ্গে মূলত প্রাথমিক সূত্রের অনুসন্ধানই জরুরী। এ জাতীয় গ্রাথমিক সূত্র অনুসরণ করে লিখিত গ্রন্থ যদি পরবর্তী সময়ে ইতিহাস চর্চায় পুনরায় ব্যবহৃত হয় তবে তাকে দ্বিতীয় পর্যায়ভুক্ত সূত্রের ভেতর অন্তর্ভুক্ত করা হয়ে থাকে। বর্তমান আলোচনায় মৌলিক উপাদান হিসাবে দু'ধরনের উপাদানকে অনুসন্ধান করা যেতে পারে। প্রথমটি প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান এবং দ্বিতীয়টি সাহিত্যিক উপাদান।

প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনার উপাদান:

প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান: প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের অঙ্গীভূত বিষয়গুলো হচ্ছে ভারতের বিভিন্ন প্রত্নস্থলে প্রাপ্ত প্রত্নবস্তু, স্থাপত্য, ভাস্কর্য, শিলালেখ, তাম্রশাসন এবং মুদ্রা।

প্রত্নবস্তু: প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান ও উৎখননের মাধ্যমে প্রাচীন ভারতে অনেক প্রত্নবস্তুর সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। এগুলো বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে ইতিহাস রচনার একটি সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। প্রত্নবস্তুর আবিষ্কার সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে আধুনিক মানুষকে পরিচিত করেছে। এ থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হয়েছে, প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে উত্তর-পশ্চিম ভারতে এক উজ্জ্বল সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল। সভ্যতার যুগের আগেও ভারতে যে পাথরযুগের মানুষের বসতি ছিল তা নিশ্চিত করছে বিভিন্ন স্থানে প্রাপ্ত প্রত্নবস্তু। পাথুরে অস্ত্র-হাত কুঠার, ছেদক, ছুরি, লাঙ্গলের ফলা প্রভৃতি যেমন প্রাগৈতিহাসিক যুগের সংস্কৃতি ও মানুষের জীবন ব্যবস্থা সম্বন্ধে ধারণা দেয় তেমনিভাবে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাসের কাঠামো নির্মাণে সহযোগিতা করে। প্রত্নবস্তু বিশ্লেষণ করে সমকালীন মানুষের রীতি-নীতি, পোশাক-পরিচ্ছদ, রুচিবোধ এবং ধর্মচিন্তা সম্বন্ধে ধারণা করা যায়।

স্থাপত্য ও ভাস্কর্য: প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান হিসাবে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস চর্চায় স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। এ সমস্ত নিদর্শন থেকে সমকালের মানুষ সংস্কৃতি ও সভ্যতায় কতটা এগিয়ে ছিল তা নির্ধারণ করা চলে। ভারতে যে সমস্ত ইমারতের ধ্বংসাবশেষ প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের মাধ্যমে আবিষ্কৃত হয়েছে তা প্রধানত ধর্মীয় স্থাপত্য (Religious Monument) এবং সামান্য কিছু পাওয়া গিয়েছে লৌকিক ইমারত (Secular Architecture)। এছাড়াও ভাস্কর্য হিসাবে পাওয়া গিয়েছে প্রচুর প্রস্তর ও ধাতব মূর্তি এবং পোড়ামাটির মূর্তি। এর পাশাপাশি পোড়ামাটির অলংকরণ এবং মৃৎপাত্রের কথাও উল্লেখ করা যেতে পারে। স্থাপত্য ও ভাস্কর্য রাজনৈতিক ইতিহাস নির্মাণে বড় রকম ভূমিকা না রাখলেও সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ইতিহাস চর্চায় এর যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। স্থাপত্য-ভাষ্কর্য বিশ্লেষণ করে সমকালের ধর্ম ও শিল্পকলা সম্বন্ধে প্রত্যক্ষভাবে ধারণা লাভ করা যায়। আবার এর ভেতর থেকে পরোক্ষভাবে খুঁজে পাওয়া যায় সমকালীন মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবন। এ সমস্ত উপাদান অনুসন্ধানের জন্য যে খনন কার্য চালানো হয়ে থাকে তার ভেতর থেকে গবেষকগণ মাটির স্তর বিন্যাস সম্বন্ধে ধারণা লাভ করতে পারেন। এই জ্ঞান ঐতিহাসিক ঘটনাসমূহের কাল নির্ণয়ে যথেষ্ট ভূমিকা রাখে।

সিন্ধু সভ্যতা আবিষ্কারের পর এর স্থাপত্য ও ভাস্কর্য বিশ্লেষণ করে হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো নগরী এবং তার সংস্কৃতি সম্বন্ধে বিশদ জ্ঞান লাভ করা সম্ভব হয়েছে। সাম্প্রতিককালে উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার চন্দ্রকেতুগড় এবং বর্ধমান জেলার মঙ্গলকোটে খনন কার্যের মাধ্যমে যে সমস্ত তথ্য পাওয়া গিয়েছে তাতে করে এ অঞ্চলের প্রাচীন ইতিহাস লেখার নতুন প্রেক্ষাপট সৃষ্টি হয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিক খননে প্রাপ্ত স্থাপত্য ও ভাস্কর্য বিশ্লেষণ করে নিশ্চিত হওয়া গিয়েছে যে পৃথিবীর প্রাচীনতম উন্নত সভ্যতাগুলোর পাশাপাশি হরপ্পা, মহেঞ্জোদারো, লোথাল, কালিবঙ্গান প্রভৃতি অঞ্চলে উন্নত সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল। সারনাথে বিহার এবং তক্ষশীলায় ভীরমাউন্ড, সিরকাপ ও সিরমুখ প্রভৃতি নগর আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে আর্য সংস্কৃতি সম্বন্ধে অনেক তথ্য জানা সম্ভব হয়েছে। এর পরবর্তী পর্যায়ের সংস্কৃতির খোঁজ পাওয়া যায় হস্তিনাপুর, কৌশাম্বী এবং আলিগড়ের নিকট অবস্থিত 'আত্রাঞ্জিখেরায়'। প্রাপ্ত প্রত্ন নিদর্শন সে যুগের ইতিহাস রচনাকে সহজ করে দিয়েছে। এ অঞ্চলের মানুষ যে লোহার ব্যবহার শুরু করেছিল তা সংশ্লিষ্ট স্থাপত্য ও ভাস্কর্য অনুসন্ধান করে জানা সম্ভব হয়েছে। বর্ধমান জেলার অজয় নদীর তীরে অবস্থিত পান্ডুরাজার ঢিবি উৎখনন করে জানা সম্ভব হয়েছে এ অঞ্চলের ভারতবাসীদের জীবন ব্যবস্থা কেমন ছিল। বৌদ্ধ বিহার ও বৌদ্ধ স্তূপগুলো একদিকে যেমন বৌদ্ধ ধর্মের অবস্থা এবং তার বিস্তার সম্পর্কে ধারণা দিচ্ছে অন্যদিকে বিভিন্ন আকৃতি ও লক্ষণ বৈশিষ্ট্যে নির্মিত বুদ্ধ মূর্তিগুলো সমকালীন সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অগ্রগতি সম্পর্কে ধারণা নেয়ার সুযোগ সৃষ্টি করছে। পোড়ামাটির মূর্তিগুলো একদিকে যেমন ধর্মীয় ধারণার প্রকাশ করছে অন্যদিকে সমকালীন মানুষের শৈল্পিক মান সম্পর্কেও ধারণা দিচ্ছে। হিন্দু মন্দির এবং বিভিন্ন দেব-দেবীর মূর্তি হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা নেয়ার পথ প্রশস্ত করেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রাপ্ত স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের সঙ্গে ভারতের প্রাচীন স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সমকালীন ভারতীয়দের যোগাযোগ কেমন ছিল তা জানা সহজ হয়েছে। স্থাপত্য বা ভাস্কর্য না হলেও পোড়ামাটির নানাবিধ অলংকার ও মৃৎপাত্রের কথা বলা যেতে পারে। এগুলো বিশ্লেষণ করে একদিকে যেমন শিল্পবোধের পরিচয় মেলে অন্যদিকে ইতিহাসের কাল নিরূপণ অনেক সহজ হয়।

শিলালেখ ও তাম্রশাসন: প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান হিসাবে শিলালেখ, স্তম্ভলিপি ও তাম্রশাসনের গুরুত্ব কম নয়। বিভিন্ন উপলক্ষ ও উদ্দেশ্যে প্রাচীন ভারতের শাসনকর্তা ও তাঁদের কর্মকর্তাগণ পাহাড়ের গায়ে বিভিন্ন শিলাস্তম্ভে, পাথরখণ্ডে, মন্দিরের গায়ে বা তামার পাতে লিপি উৎকীর্ণ করতেন। ভাষাপণ্ডিত ও লিপিবিশারদগণ এসব পাঠোদ্ধার করে ইতিহাসের অনেক সত্য উদ্‌ঘাটন করতে পেরেছেন। শিলালিপিগুলো সাধারণত ধর্মীয় বা লৌকিক ইমারতসমূহের গায়ে সাঁটা থাকতো। উৎকীর্ণ লিপিভাষ্যে প্রথা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট ইমারতের পরিচিতি, নির্মাণকাল, রাজ বা কর্মকর্তাদের পরিচিতি, নির্মাণ উদ্দেশ্য ইত্যাদি লিপিবদ্ধ করা হতো। ফলে এ থেকে রাজনৈতিক প্রশাসনিক ও ধর্মীয় ইতিহাসের একটি ছবি অংকন করা সম্ভব। এছাড়াও শিলালিপি থেকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনের ছবি খুঁজে পাওয়া অসম্ভব নয়। একই সঙ্গে শিলালিপিতে ব্যবহৃত ভাষা ও রচনাশৈলী থেকে সমকালীন ভারতীয় ভাষা এবং সাহিত্য সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। লিপিগুলোতে সাধারণত রাজ্য বিজয় বা ধর্মীয় বক্তব্যগুলো লিপিবদ্ধ থাকতো। তাম্রশাসন সাধারণত রাজাজ্ঞা অর্থাৎ রাজার গুণগান, দরিদ্রকে সাহায্য বা অনুদান দেয়া অথবা রাজার ঘোষণা প্রচার করার উদ্দেশ্যে খোদাই করা হতো। মৌর্য যুগে উৎকীর্ণ শিলালিপি, স্তম্ভলিপি, তাম্রশাসন প্রভৃতি দু'টো ভিন্ন প্রাচীন ভারতীয় লিপিতে উৎকীর্ণ করা হয়েছিল। এগুলো হচ্ছে খরোষ্ঠী ও ব্রাহ্মীলিপি। মৌর্য সম্রাট অশোকের আমলে উৎকীর্ণ লিপিসমূহ সারনাথ, শাহেট-মাহেট, ভারহত, সৌরাষ্ট্র প্রভৃতি স্থানে পাওয়া গিয়েছে। এছাড়াও প্রাচীন যুগের অনেক রাজার শিলালিপি, স্তম্ভলিপি ও তাম্রশাসন পাওয়া গিয়েছে তক্ষশীলা, মথুরা, খালিমপুর, ভাগলপুর, কোশাম, রাজগীর, সাঁচী এবং দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে। বেশ কিছু শিলালিপি পাওয়া গিয়েছে যাতে নাম লেখা ছিল 'কলিঙ্গরাজ খারবেল', 'গুপ্ত সম্রাট সমুদ্র গুপ্ত' প্রমুখের।

এ সমস্ত লিপি বিশ্লেষণ করে নির্ধারণ করা সম্ভব হয়েছে যে, ভারতের শিলালেখসমূহে চার ধরনের বক্তব্য খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন- রাজার নির্দেশাবলী, রাজার প্রশস্তি, দানপত্র এবং ধর্মীয় বক্তব্য। যে সমস্ত লিপিতে রাজা সামাজিক, ধর্মীয় ও শাসন সংক্রান্ত নির্দেশনামা জারি করতেন সেগুলোকে রাজার নির্দেশমূলক শিলালিপি বলা হয়। সম্রাট অশোকের আমলে এ জাতীয় অনেক শিলালিপি উৎকীর্ণ করা হয়েছিল। বিজেতা ও শাসক হিসাবে রাজার গৌরব প্রচারের জন্য যে সমস্ত শিলালিপি উৎকীর্ণ করা হতো তাকে বলা হয় রাজ প্রশস্তিমূলক শিলালিপি। গুপ্ত সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের কীর্তিগাথা পাওয়া যায় এলাহাবাদ স্তম্ভলিপিতে। এটি রচনা করেছিলেন হরিষেন। আরেক শ্রেণীর শিলালিপি পাওয়া যায় যা ছিল ধর্মীয় উদ্দেশ্যে দানপত্র বা বিভিন্ন উৎসর্গের দলিল। ধর্মীয় বক্তব্য প্রকাশ করা হয়েছে অনেক শিলালিপিতে। এসব লিপি পাঠে জৈন, বৌদ্ধ ও বৈষ্ণব ধর্মের অনেক তথ্যও জানা সম্ভব হয়েছে। শুধু ভারতবর্ষের ভিতরে নয় ভারতের বাইরে অনেক দেশেও কিছু শিলালিপি পাওয়া গিয়েছে। এগুলোর ভেতর উল্লেখ রয়েছে ভারতবর্ষের কথা। এশিয়া মাইনর অঞ্চলে পাওয়া শিলালিপি পাঠে আর্যদের ভারত আগমনের তথ্য জানা সম্ভব হয়েছে। এ জাতীয় অনেক শিলালিপিতেই ভারতের সঙ্গে পারস্যের সম্পর্ক সম্বন্ধে ধারণা নেয়া সম্ভব হয়েছে।

মুদ্রা: মুদ্রা গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক দলিল হিসাবে বিবেচিত। কাগজের আবিষ্কার হয়েছে অনেককাল পরে। তাই কাগুজে মুদ্রার ব্যবহার হয়েছে প্রায় আধুনিক কালে। প্রাচীনকালে বিনিময়ের মাধ্যম হিসাবে যে মুদ্রার অস্তিত্ব ছিল তাকে দু'ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমটিকে বলা হয় ছাপাঙ্কিত মুদ্রা (punch marked coin)। এগুলো সাধারণত পোড়ামাটির টুকরো বা ধাতব খণ্ডে কোন চিহ্নের ছাপ এঁকে ব্যবহার করা হতো। দ্বিতীয়টি হচ্ছে মানসম্মত ধাতব মুদ্রা। স্বর্ণ, তাম্র এবং রৌপ্যে এ জাতীয় মুদ্রা নির্মাণ করা হতো। মুদ্রার দুই পিঠে খোদাই করা হতো বিভিন্ন লিপি ও প্রতীক চিহ্ন। লিপিতে সংশ্লিষ্ট রাজার নাম, কখনও কখনও টাকশাল এবং তারিখ খোদিত থাকতো। খোদাই করা হতো বিভিন্ন দেব-দেবীর মূর্তি। ফলে এ সমস্ত মুদ্রা পাঠ করে একদিকে যেমন সহজেই রাজনৈতিক ইতিহাসের ধারাবাহিকতা নির্মাণ করা যেতো অন্যদিকে সামাজিক অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবন সম্পর্কে ধারণা নেয়াও হতো সহজ। প্রাচীনকালে ভারতে এমন অনেক শাসক ছিলেন যাঁদের অস্তিত্বের কথা শুধুমাত্র মুদ্রা থেকেই জানা যায়। উদাহরণস্বরূপ ব্যাকট্রীয় গ্রিকদের কথা উল্লেখ করা চলে। বিভিন্ন সূত্রে এদের পাঁচ-ছয় জন রাজার নামই জানা গিয়েছিল। অথচ মুদ্রার সাক্ষ্য থেকে এমন ত্রিশজন রাজার নাম জানা সম্ভব হয়েছে। সাহিত্যিক উপাদানে পাওয়া অনেক তথ্য মুদ্রা দিয়ে যাচাই করা সম্ভব হয়েছে। মুদ্রার গুণগত মান থেকে সমকালের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক জীবনের ধারণা পাওয়া সম্ভব। মুদ্রা বিশ্লেষণ করে রাজা বা সম্রাটদের রাজ্য বিজয়, রাজ্যের বিস্তৃতি বা বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কের বিষয়ে অবহিত হওয়া যায়। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে প্রাচীন ভারতীয়দের কতটা প্রভাব বিনিময় হয়েছে সে সম্পর্কে জানা যায় মুদ্রা বিশ্লেষণ করে। প্রথম দিকের ভারতীয় মুদ্রাতে বিশেষ কিছু লেখা থাকতো না। কিন্তু পরবর্তীকালের মুদ্রায় নানারকম ছবি, রাজার নাম, তারিখ, বিভিন্ন প্রতীক ইত্যাদি ব্যবহৃত হতে থাকে। শক, পহব, কুষাণ প্রভৃতি রাজবংশের আমলে এ ধরনের অনেক মুদ্রা প্রচলিত হয়েছিল। এসব বহিরাগত জাতির প্রভাবেই প্রাচীন ভারতের মুদ্রাগুলোতে বিভিন্ন ধরনের ছবি খোদিত হতে থাকে। ঐতিহাসিকদের মতে গ্রিক ও রোমান মুদ্রার অনুকরণে তৈরি বলেই পরবর্তীকালের ভারতীয় মুদ্রায় বেশ কিছু পরিবর্তন দেখা যায়। এ প্রসঙ্গে সমুদ্রগুপ্তের মুদ্রাসমূহের কথা উল্লেখ করা চলে। বেশিরভাগ মুদ্রায় তাঁকে দেখানো হয়েছে যোদ্ধার সাজে। আবার কোথাও তিনি বীণা বাজাচ্ছিলেন।

সাহিত্যিক উপাদান: ভারতের ইতিহাস রচনায় সাহিত্যের উপাদানের দু'টো ধারা রয়েছে। একটি ভারতীয় অন্যটি বৈদেশিক সাহিত্য। ভারতীয় সাহিত্য: প্রাচীন ভারতে স্থানীয় সাহিত্যের উপাদান যথেষ্ট পাওয়া যায় না। বিশেষ করে আর্য আগমনের পূর্বে সাহিত্যিক উপাদানের ক্ষেত্রে যথেষ্ট শূন্যতা রয়েছে। আর্য যুগে যে সমস্ত উপাদান পাওয়া যায় তাকে ধর্ম সাহিত্যই বলা যেতে পারে। আর্য ধর্মগ্রন্থ বেদ ছিল এ জাতীয় সাহিত্যের প্রধান নিদর্শন। এ কারণে আর্য যুগকে বৈদিক যুগও বলা হয়। কারণ এ সময়কালের যা কিছু তথ্য পাওয়া যায় তার প্রথম বিবরণ ছিল বেদের ভেতর। ভারতীয় সাহিত্যকে কতগুলো ভাগে বিভক্ত করা চলে। এগুলো হচ্ছে (ক) বৈদিক সাহিত্য (খ) পুরাণ (গ) মহাকাব্য (ঘ) হিন্দু-বৌদ্ধ ও জৈন সাহিত্য (ঙ) আইন সংক্রান্ত গ্রন্থ (চ) জীবনী সাহিত্য ও রাজ প্রশস্তি (ছ) সংস্কৃত সাহিত্য, (জ) স্থানীয় উপাখ্যান এবং (বা) প্রাচীন ঐতিহাসিক গ্রন্থ।

বৈদিক সাহিত্য: খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর আগের ইতিহাস জানার জন্য বেদ তথা বৈদিক সাহিত্যের উপরই নির্ভর করতে হয়। বেদ প্রধানত চার ভাগে বিভক্ত ছিল। এগুলো হচ্ছে ঋগবেদ, সামবেদ, যজুর্বেদ এবং অথর্ববেদ। এছাড়াও বৈদিক সাহিত্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ব্রাহ্মণ, আরণ্যক, সূত্র সাহিত্য ও উপনিষদ। চার বেদের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন হচ্ছে ঋগ্বেদ। অনুমান করা হয় ঋগ্বেদ রচনার সময়কাল খৃঃ পৃঃ ১৫০০ অব্দ থেকে খৃঃ পূঃ ১০০০ অব্দের মধ্যে। পরবর্তী বেদ এবং উপনিষদগুলোর রচনাকাল খৃঃ পূর্ব ১০০০ অব্দ থেকে খৃঃ পূঃ ৬০০ অব্দের মধ্যে বলে ধারণা করা হয়। বেদগুলোতে প্রথমদিকে ধর্মীয় প্রার্থনার বিষয়সমূহ অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং পরে এখানে বিভিন্ন উৎসব ও কল্পকাহিনী জায়গা করে নেয়। যদিও বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণ করার উপায় নেই তথাপি প্রাচীন ভারতের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনেক বিষয় সম্পর্কে ধারণা নেয়ার সুযোগ আছে বেদের বাণী বিশ্লেষণ করে। তবে বৈদিক সাহিত্যে রাজনৈতিক তথ্যের চেয়ে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক তথ্য অনেক বেশি পাওয়া যায়। আর্যদের ভারত আগমন ও তাদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে ধারণা নেয়া সম্ভব বেদের বাণী বিশ্লেষণ করে। ঋগবেদ প্রথম দিকে রচিত হলেও সাম, যজু ও অথর্ববেদ পরের যুগে রচিত হয়েছিল। অথর্ববেদে জাদুমন্ত্র ও অনেক তান্ত্রিক আচারের কথা বর্ণনা করা হয়েছে, যা প্রথম দিকের আর্যদের জানা ছিল না। এ থেকে অনুমান করা সহজ হয়েছে যে, এ দেশে আগমনের পর আর্যদের সঙ্গে অনার্যদের মিশ্রণ ঘটেছে। বেদের পরিশিষ্ট হিসাবে লিখিত ব্রাহ্মণ, আরণ্যক, উপনিষদ প্রভৃতিতে অনেক মূল্যবান ঐতিহাসিক উপাদান রয়েছে।

পুরাণ: বেদ-পরবর্তী যুগের এক ধরনের ঐতিহাসিক সাহিত্য হচ্ছে পুরাণ। ইতিহাসের উপাদান হিসাবে 'পুরাণ'-এর ওপর কতটা নির্ভর করা যায় এ ব্যাপারে ঐতিহাসিকগণের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। কারও মতে, পুরাণে বিধৃত আছে প্রাচীন ভারতের ইতিহাসেরই প্রতিচ্ছবি। আবার কারও মতে, পুরাণের ঐতিহাসিকতা সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। অবশ্য অধিকাংশের মত, প্রাচীন ভারতের নৈতিক ও সামাজিক ইতিহাস রচনায় পুরাণের সূত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তবে পুরাণকে গ্রহণ করা হয় সতর্কতার সঙ্গে। কারণ পুরাণে বর্ণিত কাহিনী খৃঃ পূঃ ৬ষ্ঠ শতাব্দী বা তারও অনেক আগের। কিন্তু পুরাণ সংকলিত হয়েছে অনেক পরে, গুপ্ত যুগে। পুরাণের সংখ্যা ১৮টি। এর মধ্যে মৎস, বায়ু, বিষ্ণু, ভাগবত এবং ভবিষ্য পুরাণ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। পুরাণ পাঠে খৃঃ পূঃ ৬ষ্ঠ শতব্দীতে মগধের বিভিন্ন রাজবংশ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়।

মহাকাব্য:মহাকাব্য বলতে সাধারণত রামায়ণ ও মহাভারতের কথা বলা হয়ে থাকে। এই প্রাচীন মহাকাব্যদ্বয়ে যথেষ্ট ঐতিহাসিক উপাদান রয়েছে। অবশ্য কোন কোন পণ্ডিতের মতে রামায়ণের ঘটনা ঐতিহাসিক নয়। একে কাল্পনিক বলেই আখ্যা দেয়া হয়েছে। তবে মহাভারতে বর্ণিত ঘটনার অনেকটাই ঐতিহাসিক বলে এক শ্রেণীর পণ্ডিতের অভিমত। সংস্কৃত ভাষায় লেখা গ্রন্থ দু'টি শুধু ইতিহাসের উপাদানের জন্যই নয়, সংস্কৃত সাহিত্যের উজ্জ্বল নিদর্শন হিসাবেও মর্যাদা লাভ করেছে। মহাভারত রচনার আনুমানিক তারিখ খৃঃ পূঃ ৫ম বা ৪র্থ শতাব্দী থেকে খ্রিস্টীয় ৪র্থ বা ৫ম শতাব্দীর মধ্যে। রামায়ণ রচিত হয়েছে খৃঃ পূঃ ৩য় বা ২য় শতাব্দী থেকে খ্রিস্টীয় ২য় বা ৩য় শতাব্দীর মধ্যে। মহাভারতে বর্ণিত কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধকে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা হিসাবে মনে করা হয়। বলা হয়ে থাকে খৃঃ পূঃ ১০০০ অব্দের দিকে এ যুদ্ধ হয়েছিল।

হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈন সাহিত্যঃ বেদ, রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ প্রভৃতি হচ্ছে হিন্দুদের প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ। এসব ধর্মগ্রন্থ থেকে বৈদিক ও পরবর্তী বৈদিক যুগের রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। একই ভাবে পালি ভাষায় রচিত বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ 'জাতক' পাঠ করে একদিকে যেমন গৌতম বুদ্ধের জীবনী সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় অন্যদিকে সমসাময়িক অনেক রাজা ও তাঁদের কর্মভূমিকা সম্পর্কে ধারণা নেয়া চলে। জাতকের ৫৫০টি শ্লোকে গৌতম বুদ্ধের জন্ম-জন্মান্তর সম্পর্কে বর্ণনা রয়েছে। জাতকের শ্লোকগুলো প্রধানত উপদেশমূলক। ঐতিহাসিক উপাদান হিসাবে জাতককে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া হয়। জাতকের বর্ণনায় খৃঃ পূঃ ৫ম থেকে ২য় শতাব্দী পর্যন্ত ভারতের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনের ছবি চিত্রিত হয়েছে। পালি ছাড়াও বেশ কয়েকটি বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ প্রাকৃত ভাষায় রচিত হয়েছিল। কুষাণ যুগ থেকে বৌদ্ধ গ্রন্থগুলো সংস্কৃত ভাষায় রচিত হয়। খৃঃ পূঃ ৬ষ্ঠ শতাব্দীর ভারতের রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবন সম্পর্কে বৌদ্ধ সাহিত্যে অনেক তথ্য পাওয়া যায়। সিংহলে রচিত বৌদ্ধ সাহিত্য দ্বীপবংশ ও মহাবংশ হতে বুদ্ধের জন্ম তারিখ এবং চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের বংশ পরিচয় সম্বন্ধে অনেক তথ্য পাওয়া যায়। বৌদ্ধ গ্রন্থ 'ললিত বিস্তার'ও বৌদ্ধের জীবনীগ্রন্থ হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়াও একই ধারার গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হচ্ছে অশ্বঘোষের 'বুদ্ধচরিত।' জৈন গ্রন্থগুলোর মধ্যে 'ভগবতী সূত্র' ও 'আচারাঙ্গ সূত্র' ঐতিহাসিকদের নিকট যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। প্রাকৃত ভাষায় রচিত জৈন সাহিত্য ভারতের ইতিহাসে মূল্যবান দলিল হিসাবে চিহ্নিত।

আইন সংক্রান্ত গ্রন্থ: প্রাচীন ভারতের সাহিত্য বলতে সাধারণত ধর্মগ্রন্থকেই বোঝানো হয়। তবে ধর্ম ছাড়াও সামান্য কিছু গ্রন্থ রচিত হয়েছে। এগুলো হচ্ছে কয়েকটি প্রাচীন আইন সংক্রান্ত গ্রন্থ। যেমন ধর্মসূত্র, স্মৃতি, অর্থশাস্ত্র প্রভৃতি। এসব গ্রন্থের প্রধান ভূমিকায় থাকতেন রাজা বা রাজপুরুষগণ। অন্যপক্ষে অবস্থান করতো রাজ কর্মচারী ও বিভিন্ন বর্ণের মানুষ। গ্রন্থসমূহের বিষয়বস্তু ছিল উভয়পক্ষের মানুষের মধ্যকার দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ সচেতন করে তোলা। এ গ্রন্থগুলোতে বিভিন্ন অপরাধের জন্য শাস্তির বিধানও লিপিবদ্ধ করা থাকতো। তবে এসব গ্রন্থে কোন কোন ক্ষেত্রে ধর্মের প্রভাব থেকে গিয়েছিল। ব্রাহ্মহ্মণ বা ধর্মগুরুরাই এসব গ্রন্থের লেখক ছিলেন বলে ধর্মের প্রভাব এড়ানো যায়নি। 'ধর্মশাস্ত্র' গ্রন্থ হচ্ছে ধর্মসূত্র ও স্মৃতি এ দুই গ্রন্থের একত্রিত রূপ। ধর্মশাস্ত্রে সম্পত্তির অধিকার বিষয়ে কয়েকটি সিদ্ধান্ত ছিল। যেমন- সম্পত্তির অধিকারের কি কি শর্ত পালন করতে হবে অথবা সম্পত্তির উত্তরাধিকারী নির্বাচনে কি কি নিয়ম কার্যকর থাকবে এসব কথা ধর্মশাস্ত্র গ্রন্থে লিপিবদ্ধ থাকতো। ভারতে রাজনীতি বিষয়ক সবচেয়ে প্রাচীন এবং নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ হচ্ছে কৌটিল্য রচিত 'অর্থশাস্ত্র'। খুব সহজ ভাষায় অর্থশাস্ত্র লিপিবদ্ধ ছিল। রাষ্ট্র ব্যবস্থার সকল দিকেই আলোকপাত করা হয়েছে অর্থশাস্ত্রে। এ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলো হচ্ছে কেন্দ্রীয়, প্রাদেশিক ও স্থানীয় শাসন ব্যবস্থা সংক্রান্ত অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতি, দীউয়ানি ও ফৌজদারি আইন এবং যুদ্ধ সংক্রান্ত নীতি ইত্যাদি। (অর্থশাস্ত্র সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ ত্রয়োদশ অধ্যায়ে দ্রষ্টব্য)। অর্থশাস্ত্র এবং বাৎসায়ণের 'কামসূত্র'-এর রচনাকাল প্রায় কাছাকাছি সময়ে বলে পণ্ডিতদের অনুমান। এ কারণে ধারণা করা হয় এ দু'ই গ্রন্থে অনেক ব্যাপারেই মিল রয়েছে।

জীবনী সাহিত্য ও রাজ প্রশস্তি: ইতিহাসের তথ্য সন্ধানে প্রাচীন ভারতে রচিত বেশ কয়েকটি জীবনীগ্রন্থ বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। প্রতাপশালী রাজাগণ তাঁদের গৌরবময় কর্মজীবন এবং রাজত্বকালের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাসমূহ লিপিবদ্ধ করে রাখতেন। অনেক রাজাই নিজেদের জীবনকাহিনী লেখার জন্য জীবনীকারদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। এসব জীবনচরিতে সংশ্লিষ্ট রাজার রাজত্বকালের কাহিনী পাওয়া যেতো। গ্রন্থসমূহের মধ্যে কয়েকটির নাম করা যেতে পারে। যেমন- বাণভট্টের 'হর্ষচরিত', কিল্ল্লহণের 'বিক্রমাঙ্কদেব চরিত', পদ্মগুপ্তের 'নবসাহসাঙ্ক চরিত', সন্ধ্যাকরনন্দির 'রামচরিত', বাষ্পতির 'গৌড়বহো', জয়সিংহ এবং হেমচন্দ্রের 'কুমারপাল চরিত', ন্যায়চন্দ্রের 'হামির কাব্য', বল্লাল চরিত, 'ভোজ প্রবন্ধ' ইত্যাদি। এ গ্রন্থগুলোকে বিজ্ঞানসম্মত ইতিহাস বলা যাবে না। কারণ এখানে রাজাকে সন্তুষ্ট করার জন্য অনেক অতিরঞ্জন করা হতো। তাই জীবনচরিতের তথ্যগুলোকে সতর্কতার সঙ্গে ব্যবহার করতে হয়। তবে যে যুগের ইতিহাস তৈরিতে সূত্রের সংকট সে সময়ে কখনও কখনও কোন জীবনচরিত উজ্জ্বল আলোর সন্ধান দিতে পারে। এক্ষেত্রে মহাকবি অশ্বঘোষের লেখা 'বুদ্ধচরিত' কাব্যের কথা বলা যেতে পারে। অশ্বঘোষ ছিলেন কুষাণ যুগের বিখ্যাত পণ্ডিত। তিনি বাস্তব তথ্য ও লোককাহিনীর উপর ভিত্তি করে গৌতম বুদ্ধের এ জীবনী রচনা করেছিলেন। অতিরঞ্জন থাকলেও এর ভেতর থেকে গৌতম বুদ্ধ সম্পর্কিত মূল্যবান তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব। বাণভট্টের 'হর্ষচরিত' হর্ষবর্ধনের রাজত্বকালের প্রথমপর্বের গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের যোগান দিয়ে থাকে। গৌড়বহ কাব্য থেকেই প্রথম যশোবর্মনের গৌড় বিজয়ের কথা জানা যায়। চালুক্য রাজ ৬ষ্ঠ বিক্রমাদিত্যের গৌরবের কথা জানা যায় বিক্রমাঙ্কদেব চরিত কাব্যে। মনে করা হয় রামচরিত কাব্যে রামচন্দ্র এবং পাল রাজা রামপালের কাহিনী উভয়ই লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।

সংস্কৃত সাহিত্য: যদিও আইন সংক্রান্ত গ্রন্থ প্রসঙ্গে কিছু সংস্কৃত গ্রন্থের কথা আলোকপাত করা হয়েছে তবুও এর বাইরে বেশ কয়েকটি সংস্কৃত সাহিত্যের সন্ধান পাওয়া যায়। যা ইতিহাস রচনায় বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এগুলোর মধ্যে পাণিনি ও পতঞ্জলীর 'ব্যাকরণ' গ্রন্থের কথা বলা যেতে পারে। পরোক্ষভাবে এখানে অনেক ঐতিহাসিক উপাদান রয়েছে। বিশাখ দত্তের 'মুদ্রা রাক্ষস' গ্রন্থ থেকে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য পাওয়া যায়। 'দেবীচন্দ্র গুপ্তম্' নামক নাটক হতে সমুদ্র গুপ্ত এবং দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে রাজা রামগুপ্তের কথা জানা যায়। মৌর্য রাজত্বকালের শেষ দিকে ব্যাস্ট্রীয় গ্রিকরা যে আক্রমণ করেছিল সে তথ্য পাওয়া যায় 'গার্গী সংহিতা' নামের এক জ্যোতিষ বিষয়ক গ্রন্থে।

স্থানীয় উপাখ্যান ও ঐতিহাসিক গ্রন্থঃ প্রাচীন ভারতের বিভিন্ন ঘটনা জড়িয়ে থাকা কিছু স্থানীয় উপাখ্যান ও ঐতিহাসিক গ্রন্থ রয়েছে। যার ভেতর থেকে ইতিহাস রচনার উপাদান খুঁজে নেয়া সম্ভব হয়। এগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সিংহলের 'মহাবংশ', 'দ্বীপবংশ' এবং কলহন রচিত 'রাজতরঙ্গিণী'। রাজতরঙ্গিণী মূলত কাশ্মীরের ইতিহাস গ্রন্থ। দ্বাদশ শতাব্দীর মাঝ পর্বে কাব্যের আকারে এ গ্রন্থটি লিখিত হয়েছিল। কলহন গ্রন্থ রচনার যে পদ্ধতির কথা বর্ণনা করেছেন তাতে পণ্ডিতদের ধারণা বিজ্ঞানমনস্ক আধুনিক ইতিহাস লেখার কিছুটা জ্ঞান তাঁর ছিল। এ কারণে রাজতরঙ্গিণী গ্রন্থটিকে ভারতে রচিত প্রথম ঐতিহাসিক গ্রন্থ বলা হয়ে থাকে। এসব ছাড়াও গুজরাট, সিন্ধু এবং নেপালে বেশ কয়েকটি উপাখ্যান রচিত হয়েছিল।

বৈদেশিক সাহিত্য: বিদেশী পর্যটক ও লেখকদের বিবরণ এক্ষেত্রে বৈদেশিক সাহিত্য হিসাবে বিবেচিত হবে। এসকল লেখক ছিলেন গ্রিক, রোমান, চৈনিক, মুসলিম এবং তিব্বতীয়। তাঁদের লেখার দুর্বল দিক হচ্ছে তাঁরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে জনশ্রুতির উপর নির্ভর করে ইতিহাস লিখেছেন। আর সবল দিক হচ্ছে ভ্রমণকালে ভারতের জনজীবন, অর্থনীতি, ধর্ম, সংস্কৃতি যা কিছু দেখেছেন তাকেই তুলে ধরেছেন লেখনীতে। মূলত ভারতে গ্রিক লেখকগণ এসেছিলেন আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের সময়ে। তাঁর পূর্বেও দু'জন গ্রিক ইতিহাস ব্যক্তিত্বের লেখায় ভারত প্রসঙ্গ খুঁজে পাওয়া যায়। এঁদের একজন ইতিহাসের জনক হেরোডোটাস এবং অন্যজন টেসিটাস। হেরোডোটাস ভারতে না এলেও খৃঃ পূঃ ৫ম শতাব্দীতে তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ 'পারসিয়া'য় (Persea) পারস্যবাসীর উত্তর ভারত আক্রমণ ও অধিকারের কথা লিপিবদ্ধ করেছেন। একই সঙ্গে তাঁর রচনায় এ অঞ্চলের মানুষের জীবনকাহিনী লিপিবদ্ধ হয়েছে।

ভারতীয় সাহিত্য বা সংশ্লিষ্ট অন্য কোন গ্রন্থে আলেকজান্ডারের উত্তর-পশ্চিম ভারত আক্রমণের বিবরণ পাওয়া যায় না। এক্ষেত্রে নির্ভর করতে হয় গ্রিক লেখকদের রচনার উপর। আলেকজান্ডারের সফরসঙ্গী নিয়ারকাস, এ্যারিস্টবুলাস এবং ওনেসিক্রিটাস এ সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য রেখে গিয়েছেন। গ্লিক রাষ্ট্রদূত মেগাস্থিনিস পাটলিপুত্রে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের রাজসভায় অবস্থান করেছিলেন। নিয়ারকাস এবং ওনেসিক্রিটাস সিন্ধু নদে নৌ ভ্রমণ করেছিলেন। আলেকজান্ডারের অভিযানের সঙ্গী ছিলেন এ্যারিস্টবুলাস। তাঁরা তাঁদের নিজ নিজ অভিজ্ঞতাব বর্ণনা করেছেন ভ্রমণ বৃত্তান্তে। এসব তথ্য নিয়ে পরবর্তীকালে অনেক বিদেশী লেখক ভারত সম্পর্কে বেশ কিছু গ্রন্থ লিখেছিলেন। গ্রিক লেখকদের বিবরণীতে সাধারণত রাজনেতিক তথ্য প্রাধান্য পেতো। আর চীনা ভ্রমণকারীদের বিরবণীতে বেশি থাকতো ধর্মীয় তথ্য। এর প্রধান কারণ চীনা ভ্রমণকারীরা ছিলেন সাধারণত তীর্থযাত্রী। তিব্বতীয় লেখক এবং আবব ভ্রমণকারীরা অনেক ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক বিবরণ লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন। এসব বিদেশী সাহিত্যের বিবরণ প্রাচীন ভারতকে জানার অনেক সুযোগ তৈরি করেছে।

মেগাস্থিনিসের বিখ্যাত গ্রন্থ 'ইন্ডিকা' শুধু মৌর্য শাসন ব্যবস্থার বিবরণই দেয়নি, সে যুগের সমাজ ও অর্থনীতি সম্পর্কেও একটি চিত্র তুলে ধরেছে। (ইন্ডিকা সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ ত্রয়োদশ অধ্যায়ে দ্রষ্টব্য)। গুপ্ত ও গুপ্ত পরবর্তী যুগের ইতিহাসের উপাদান পাওয়া যায় চৈনিক পর্যটকদের বিবরণীতে। সপ্তম শতাব্দীর শেষার্ধে ভারত পর্যটন করেছিলেন ইৎ সিং। তাঁর বিবরণীতে গুপ্তদের আদি বাসস্থান সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। গুপ্ত শাসক দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সময় চীন থেকে এসেছিলেন ফা-হিয়েন। গুপ্ত যুগের শাসনব্যবস্থা ও সমাজ সম্পর্কে বিশদ বিবরণ আছে তাঁর বর্ণনায়। ভারতের গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল এবং বিশেষ করে গৌতম বুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত অঞ্চলগুলো তিনি পরিভ্রমণ করেছিলেন। গুপ্ত যুগের পরে ভারতে এসেছিলেন বিখ্যাত চীনা পর্যটক হিউয়েন সাঙ। ফা-হিয়েনের চেয়ে তাঁর বর্ণনা অনেক বেশি বিজ্ঞানসম্মত। বৌদ্ধ ধর্মের আকর্ষণেই হিউয়েন সাঙ ভারতে এসেছিলেন। হিউয়েন সাঙ-এর আলোচনার মধ্য দিয়ে সমকালীন ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, বিভিন্ন রাজ্যের সঙ্গে হর্ষবর্ধনের সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয় ফুটে উঠেছে। একাদশ শতাব্দীতে ভারত সম্পর্কে বিস্তারিত লিখেছেন বিখ্যাত আরব পর্যটক আল বিরুণী। তাঁর লিখিত গ্রন্থটির নাম 'তহকিক-ই-হিন্দ' বা 'ভারত তত্ত্ব'। এ গ্রন্থে ভারতের সমকালের সামাজিক জীবনের বিস্তারিত বিবরণ লিপিবদ্ধ হয়েছে। আল বিরুণী ছাড়াও আরও কয়েকজন আরব পর্যটক ও ভূগোলবিদের নাম জানা যায়, যাঁদের রচনা থেকে পাওয়া যায় প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের অনেক উপকরণ। এঁরা হচ্ছেন সুলেমান, আল মাসুদি, হাসান নিজামি প্রমুখ। 

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Out
Ok, Go it!
Join