স্মার্ট বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় ডিজিটাল ব্যাংক 2023

Mohammad Rashed
0

স্মার্ট  বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় ডিজিটাল ব্যাংক

স্মার্ট  বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় ডিজিটাল ব্যাংক 2023

নিত্যনতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে সমগ্র বিশ্বে অন্যান্য খাতের মতো আর্থিক খাতেও সেবা প্রদানের ‍ধরনে বৈচিত্র্য এসেছে। বাংলাদেশেও ব্যাংক এবং আর্থিক সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ তাদের প্রচলিত সেবা প্রদানের পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে এসে প্রযুক্তিনির্ভর আর্থিক সেবা প্রদানে আগ্রহী। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আর্থিক অন্তর্ভুক্তির লক্ষ্যে বিভিন্ন বিকল্প ডেলিভারি চ্যানেল, তথ্য মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (MFS) এবং অন্যান্য ই-ওয়ালেটের মাধ্যমে ডিজিটাল পদ্ধতিতে আর্থিক সেবা প্রদানের জন্য ব্যাংক ও অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে অনুমতি দেয়। বাংলাদেশ সরকারের ঘোষিত লক্ষ্য ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বিনির্মাণের উদ্দেশ্যে বিশ্বব্যাপী প্রচলিত তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর ডিজিটাল ব্যাংকিং সেবা জনগণের কাছে পৌছে দেওয়ার মাধ্যমে ক্যাশলেস বাংলাদেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ডিজিটাল ব্যাংক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে ব্যাংক ব্যবস্থার আইনি কাঠামো, দেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট, প্রযুক্তিনির্ভর ব্যাংক ব্যবস্থায় বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান েইত্যাদি বিষয়গুলো বিশ্লেষণপূর্বক ‘ডিজিটাল ব্যাংক স্থাপনবিষয়ক গাইডলাইনস’ প্রণয়ন করা হয়েছে। উল্লেখ্য, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল 1 জুন 2023 জাতীয় সংসদে 2023-24 অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় ডিজিটাল ব্যাংক চালুর ঘোষণা দেন।

ডিজিটাল ব্যাংক

ডিজিটাল ব্যাংক বলতে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে পরিচালিত ব্যাংককে বোঝায়। এটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম, মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন এবং অন্যান্য ডিজিটাল চ্যানেলের মাধ্যমে গ্রাহকদের সেবা দিয়ে থাকে। ডিজিটাল ব্যাংক বিনা শাখা বা ঐচ্ছিক কাগজপত্রিক পদ্ধতিতে গ্রাহকদের প্রয়োজনীয় কার্যক্রম সম্পাদন, যেমন অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্স চেক, অর্থ স্থানান্তর, বিল পরিশোধ, ঋণ আবেদন, নতুন অ্যাকাউন্ট খোলা এবং আরও অনেক কিছু করার সুযোগ প্রদান করে । ব্যয় সাশ্রয়ী ও উদ্ভাবনীমূলক ডিজিটাল আর্থিক পণ্য ও সেবা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নিকট সহজলভ্য করার জন্য ডিজিটাল ব্যাংকে অনলাইন প্রযুক্তিনির্ভর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, মেশিন লার্নিং, ব্লকচেইন এবং চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের অন্যান্য অগ্রসরমান প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়।

ব্যাংক স্থাপনের শর্ত

প্রতিটি ডিজিটাল ব্যাংকের ন্যূনতম পরিশোধিত মূলধন হবে ১২৫ কোটি টাকা। ডিজিটাল ব্যাংকের প্রত্যেক উদ্যোক্তাকে কমপক্ষে ৫০ লাখ টাকা মূলধন জোগান দিতে হবে। উদ্যোক্তা ও শেয়ারহোল্ডারদের বিনিয়োগকৃত অর্থ কোনো ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, পরিবারের সদস্য বা অন্য কোনোউৎস থেকে ধার বা ঋণ নেওয়া যাবে না। কোনো ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতে পড়লে তা উদ্যোক্তাদের জোগান দিতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক লাইসেন্স বা সনদ দেওয়ার পাঁচ বছরের মধ্যে এই ব্যাংককে দেশের পুঁজিবাজারে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (IPO) মাধ্যমে শেয়ার ছাড়তে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবসা শুরু হওয়ার ৫ বছরের মধ্যে শেয়ার হস্তান্তর করা যাবে না। ডিজিটাল ব্যাংককে কোম্পানি আইন অনুযায়ী, প্রচলিত ব্যাংকের মতো সময়ে সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারিত ন্যূনতম নগদ জমা (CRR) ও বিধিবদ্ধ জমা (SLR) বজায় রাখতে হবে। কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ঋণখেলাপি কোনো প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি বা তার পরিবারের কোনো সদস্য ডিজিটাল ব্যাংকের উদ্যোক্তা হতে পারবেন না। ডিজিটাল ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার (CEO) প্রযুক্তিভিত্তিক ব্যাংকিং, ব্যাংকিং রেগুলেশন ও নির্দেশনা ইত্যাদি বিষয়ে কমপক্ষে ৫ বছরের অভিজ্ঞতাসহ ব্যাংকিং পেশায় কমপক্ষে ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। ডিজিটাল ব্যাংকের শক্তিশালী, পরিশীলিত, পরিচালনযোগ্য ICT অবকাঠামো এবং অ্যাপ্লিকেশন সিস্টেম থাকতে হবে। এ ব্যবস্থায় কমপক্ষে টিয়ার থ্রি ডাটা সেন্টার (DC) এবং ভিন্ন সিসমিক জোনে ডিজাস্টার রিকভারি সাইট (DRS) থাকতে হবে ।

পরিচালনা পদ্ধতি

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, প্রতিটি ডিজিটাল ব্যাংককে ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১ এর ধারা ৩১ এর আওতায় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে লাইসেন্স গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া পরিশোধ সেবা (পেমেন্ট সার্ভিস) পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ পেমেন্ট অ্যান্ড সেটেলমেন্ট সিস্টেমস রেগুলেশন, ২০১৪ এর বিধানগুলো অনুসরণ করতে হবে। ডিজিটাল ব্যাংক পরিচালনার জন্য প্রধান কার্যালয় থাকবে এই কার্যালয়ে সরাসরি বা অনলাইন দু'ভাবেই গ্রাহকের অভিযোগ গ্রহণ ও সমাধানের জন্য বিভাগ থাকবে। তবে সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে এটি হবে স্থাপনাবিহীন। অর্থাৎ এই ব্যাংক কোনো ওভার দ্য কাউন্টার (OTC) সেবা দেবে না। এর নিজস্ব কোনো শাখা বা উপশাখা, এটিএম, সিডিএম বা সিআরএমও থাকবে না। সব সেবাই হবে অ্যাপনির্ভর, মুঠোফোন বা ডিজিটাল যন্ত্রে। গ্রাহকদের সুবিধার্থে ডিজিটাল ব্যাংক ভার্চুয়াল কার্ড, কিউআর কোড ও অন্য কোনো উন্নত প্রযুক্তিভিত্তিক পণ্য দিতে পারবে। তবে লেনদেনের জন্য কোনো প্লাস্টিক কার্ড দিতে পারবে না । অবশ্য এই ব্যাংকের সেবা নিতে গ্রাহকেরা অন্য ব্যাংকের এটিএম, এজেন্টসহ নানা সেবা ব্যবহার করতে পারবেন। তবে ডিজিটাল ব্যাংকের নিজস্ব কোনো এজেন্ট থাকবে না। ডিজিটাল ব্যাংক কোনো ঋণপত্র (LC) খুলতে পারবে না। বড় ও মাঝারি শিল্পেও কোনো ঋণ দিতে পারবে না। শুধু ক্ষুদ্র ঋণ দিতে পারবে ।

আবেদন গ্রহণ

ডিজিটাল ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় ২১ জুন-১ আগস্ট ২০২৩ আগ্রহীদের কাছ থেকে আবেদন গ্রহণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। অনলাইনে আবেদন জমা নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে আলাদা একটি পাতা খোলা হয়। সেখানে আগ্রহী ব্যক্তিরা আবেদন জমা দেন । আবেদন ফি বাবদ বাংলাদেশ ব্যাংককে পাঁচ লাখ টাকা জমা দিতে হয়, যা অফেরতযোগ্য। গতানুগতিক পদ্ধতিতে কাগুজে নথি জমা দিয়ে নয়, ডিজিটাল পদ্ধতিতেই ডিজিটাল ব্যাংকের জন্য আবেদন করতে হয়। অর্থাৎ প্রয়োজনীয় সব নথিপত্র ডিজিটাল উপায়েই জমা দিতে হয় । ব্যাংকিং কোম্পানি আইন ১৯৯১-এর অধীনে ডিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্স প্রদান করা হবে।

গ্রাহকদের সুবিধা

অন্যান্য দেশে যেভাবে ডিজিটাল ব্যাংক চালু হয়েছে, বাংলাদেশেও এটি চালু হলে গ্রাহকরা নিম্নলিখিত সুবিধাদি পাবেন

• ব্যাংকে যেতে না হওয়ায় গ্রাহকদের সময় সাশ্রয় হবে।

• ব্যাংকের শাখা খুলতে না হওয়ায় ব্যয় অনেক কমে যাবে। ফলে ব্যাংকগুলো কম খরচে গ্রাহকদের সেবা দিতে পারবে।

• একজন গ্রাহক ঘরে বসেই অনলাইনে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আপলোড করে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে পারবেন। বাংলাদেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে গ্রাহক ব্যাংকিং সেবা নিতে পারবেন ।

• ডিজিটাল ব্যাংকে বিভিন্ন পরিষেবা বিল, মাশুল জমা দেওয়া, টাকা স্থানান্তর, কেনাকাটার মতো বিভিন্ন সেবা যুক্ত হবে

• জামানতের অভাবে প্রচলিত ব্যাংক ব্যবস্থায় অনেকেই ঋণ নিতে পারেন না। ডিজিটাল ব্যাংকের মাধ্যমে গ্রাহকরা বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা সহজেই জামানতবিহীন ঋণ নিতে পারবেন ।

• ২৪ ঘণ্টার যেকোনো সময় এই ব্যাংকের সেবা নেওয়া যাবে।

• ডিজিটাল ব্যাংকের মাধ্যমে ব্যাংক ঋণের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ফিরবে। কেননা ডিজিটাল প্রযুক্তিতে পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব করা সম্ভব ।

চ্যালেঞ্জ

সম্ভাবনাময় হলেও ডিজিটাল ব্যাংকিং ব্যবস্থা সবার জন্য সমান এবং স্বচ্ছ হবে কি না তা নিয়ে অনেকের মধ্যে সংশয় রয়েছে। বাংলাদেশে এখনো প্রান্তিক অনেক মানুষ প্রচলিত ধারার ব্যাংকিং সেবার আওতায় আসেনি। অন্যদিকে প্রযুক্তি ব্যবহারে অনেকের দক্ষতার অভাব এবং প্রযুক্তি নির্ভর আধুনিক মোবাইল ফোন না থাকায় তাদের এ ধরনের ব্যাংকিং সেবা নেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে মোবাইল ব্যাংকিং সেবার সাথে যেভাবে মানুষজন অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে, তাতে ডিজিটাল ব্যাংকিং সেবার সাথেও কয়েক বছরের মধ্যেই মানুষ খাপ খাইয়ে নেবে।

 প্রচলিত ব্যাংকের সাথে পার্থক্য

প্রচলিত ব্যাংক সময় নির্ভর, অনেক সেবার জন্য সশরীরে যেতে হয়। ঋণ নেওয়া, আমানত খোলা, স্টেটমেন্ট নেওয়ার জন্য অনেক সময় ব্যাংকে যেতে হয়। সেখানে গিয়ে কাগজপত্রে স্বাক্ষর করতে হয়। ডিজিটাল ব্যাংকের কোনো শাখা, উপশাখা বা সশরীরে লেনদেনের কোনো ব্যবস্থা থাকবে না। প্রচলিত ব্যাংকগুলোতে এখনো অর্থ লেনদেন, হিসাব দেখার মতো কিছু সেবা ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে করা হয়। কিন্তু নতুন ডিজিটাল ব্যাংকে সকল কাজ হবে প্রযুক্তি নির্ভর। শুধু মোবাইল, কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট ব্যবহার করেই ডিজিটাল ব্যাংকের সেবা পাওয়া যাবে। অর্থাৎ সকল বিষয় হবে ভার্চুয়ালি ।

সীমিত বৈদেশিক লেনদেন

বৈদেশিক বাণিজ্য নীতিমালায় অথোরাইজড ডিলার (এডি) লাইসেন্স নেওয়ার সুযোগ রয়েছে ডিজিটাল ব্যাংকের। লেনদেনের সব রেকর্ড সংরক্ষণ করে বৈদেশিক মুদ্রায় ফরেন টেড ও গ্যারান্টি সার্ভিস ছাড়া সাধারণ লেনদেন করতে পারবে এ ধরনের ব্যাংক। অর্থাৎ, ডিজিটাল ব্যাংক বৈদেশিক বাণিজ্যে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। তবে অন্যান্য সেবার মধ্যে বিদেশ থেকে রেমিটেন্স গ্রহণ ও এফসি হিসাব পরিচালনা করতে পারবে। ডিজিটাল ব্যাংক কারো পক্ষে পেমেন্ট বা পরিশোধকারী ব্যাংক হিসেবে কাজ করতে পারবে। বিদেশে লেখাপড়া, চিকিৎসা, ভ্রমণ বা অন্য কোনো প্রয়োজনে অনুমোদন সাপেক্ষে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন করতে পারবে ।

২০৪১ সালের মধ্যে ৭৫% ব্যাংকিং লেনদেন ক্যাশলেস করার যে লক্ষ্য, তা বাস্তবায়নের জন্য ডিজিটাল ব্যাংকই একমাত্র উপায় । দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারত ও পাকিস্তান ২০২২ সালে ডিজিটাল ব্যাংক চালু করেছে। সারা বিশ্বে নতুন প্রজন্মের ব্যাংকগুলো যখন প্রথাগত ফিজিক্যাল ব্যাংক থেকে মুখ ফিরিয়ে ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের দিকে ঝুঁকছে, তখন বাংলাদেশে ডিজিটাল ব্যাংক স্থাপনের ঘোষণা এক যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত ।





Post a Comment

0Comments

Post a Comment (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Ok, Go it!