বর্তমান ইসলামী সংস্কৃতি ও আমাদের করণীয় - Current Islamic culture and our actions

Mohammed Ahsan
0

বর্তমান ইসলামী সংস্কৃতি  ও আমাদের করণীয়

মুনতাসির মাহমুদ

র্বতামান ইসলামী সংস্কৃতি  ও আমাদের করণীয় -  Current Islamic culture and our actions


'ইসলামী সংস্কৃতি কী' এটি নিয়ে আলাপ করার পূর্বে আমাদের বুঝতে হবে 'সংস্কৃতি' বিষয়টি কী এবং রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এই এর আদর্শের কোন উদ্দীপকগুলো আমাদেরকে বর্তমান আধুনিক সমাজে ইসলামী সংস্কৃতি আনয়নের ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। বিশেষত সমাজবিজ্ঞানী টেলরের মতে, সমাজের সদস্য হিসেবে অর্জিত আচার-আচরণ, ব্যবহার, জ্ঞান, বিশ্বাস, শিল্পকলা, নীতি, প্রথা, আইন ইত্যাদির সমাবেশই হলো সংস্কৃতি। যদিও এই সংজ্ঞা অনুসারে সংস্কৃতির গতি খুবই ধীর ও মন্থর কিন্তু ইসলামের সঠিক রূপরেখায় যে শক্তি বা প্রতিপত্তি রয়েছে, তাতে করে সংস্কৃতির রূপান্তর বা পরিবর্তন খুবই দ্রুততার সাথে করা যায়।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তার সংক্ষিপ্ত নবুয়তি জিন্দেগিতে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছেন, তা আমাদের সুস্থ ও নৈতিক সংস্কৃতির পথে খুবই উপকারী। যদিও সময়ের পরিবর্তনের ফলে আমাদের এই পথ অনুসরণ করার সময় সতর্ক থাকতে হবে, যাতে জনগণের জন্য তা কষ্টকর হয়ে না পড়ে। কষ্টকর হয়ে পড়লে তা থেকে মনুষ্য সমাজ বিচ্যুত হয়ে পড়বে এবং দিনশেষে এর ফলাফল হবে শূন্য। একারণে আমাদের হিকমাহ অবলম্বন করতে হবে।

শুধু বলায় কওয়ায় কোনো একটি সংস্কৃতিকে পরিবর্তন করা যায় না। সম্প্রতি এ দৃশ্য আমাদের নিকট খুবই চোখে পড়ছে যে, কিছু গোষ্ঠী বা দল আমাদের নিকট প্রবৃত্তির অনুসৃত কিছু পন্থা অবলম্বন করে দুনিয়াবি চাহিদা মোতাবেক কিছু নির্দিষ্ট কাজকে ইসলামি নামকরণ করার পায়তারা চালাচ্ছে, যা একজন প্র্যাক্টিসিং মুসলমানের কাজ হতে পারে না। ঐসমস্থ গোষ্ঠীর কিছু যুক্তি আমি তুলে ধরছি। এক. কোনো বিধর্মীয় বা অধার্মিক অথবা অশ্লীল সংস্কৃতিকে বিলুপ্ত করতে প্রয়োজন বিকল্প সংস্কৃতির।

দুই. নফস তথা প্রবৃত্তিকে পূর্ণতা প্রদান করে, এমন তৃপ্তিদায়ক সংস্কৃতিকে ইসলাম অনুযায়ী সংস্করণ করা।

এ দু'ধরণের যুক্তিতেই কিছু অতিরিক্ত তথ্য সংযোজনের প্রয়োজন আছে। কেননা সরাসরি এ যুক্তিদ্বয়ের আদলে ইসলামী সংস্কৃতি বানানোর চেষ্টা করা হলে তা আদতে প্রবৃত্তির পূজাকেই সমাসীন করবে।

যেমন ধরুন, রাসূলূল্লাহ (সাঃ) এর যুগে মদ জাতীয় দ্রব্যকে ধীরে ধীরে ক্রমান্বয়ে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছিল; কেননা তা ছিলো অভ্যাসগত সংস্কৃতি । অভ্যাসগত সংস্কৃতি থেকে হুট করেই কোনো বিষয়কে আলাদা করা যায় না। যার জন্য প্রয়োজন হয়েছিল হিকমাহ অর্থাৎ ধীরে ধীরে মানুষ যখন আল্লাহর কাছে সম্পূর্ণভাবে তাদের নিজের জীবনকে সঁপে দিয়েছিল, ঠিক তখনই মদ জাতীয় দ্রব্যকে হারাম সাব্যস্ত করা হয়েছিল। এ ব্যাপারে সে সময়ের সাহাবায়ে কেরামদের ইমান কেমন পরিবর্তন হয়েছিল, তা আমরা রাসুল (সাঃ) এর হাদিসেই দেখতে পাই। যেমন আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন যে, তোমরা যেটাকে ফাযীখ অর্থাৎ কাঁচা খুরমা ভিজানো পানি নাম রেখেছ সেই ফাযীখ ব্যতীত আমাদের অন্য কোন মদ ছিল না। একদিন আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আবূ ত্বলহা, অমুক এবং অমুককে তা পান করাচ্ছিলাম। তখনই এক ব্যক্তি এসে বলল, আপনাদের কাছে এ সংবাদ এসেছে কি? তাঁরা বললেন, ঐ সংবাদ কী? সে বলল, মদ হারাম করে দেয়া হয়েছে। তাঁরা বললেন, হে আনাস! এই বড় বড় মটকাগুলো থেকে মদ ঢেলে ফেলে দাও। আনাস বললেন যে, এই ব্যক্তির সংবাদের পর তাঁরা এ ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেসও করেননি এবং দ্বিতীয়বার পানও করেননি।

সেসময় আরবের মানুষেরা তিনটি বিষয়ে প্রচন্ডরকম আসক্ত ছিলো, এর মাঝে একটি হচ্ছে মদ । অথচ তাদের ইমান তখন এতটাই মজবুত হয়ে গিয়েছিলো যে, তাদেরকে সেই অভ্যাসগত সংস্কৃতি থেকে ফেরাতে শুধু রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর জবানই যথেষ্ট ছিলো। এ থেকে বুঝা যায়, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর শর্তহীন আনুগত্য ও সীমাহীন ভালোবাসাও আমাদেরকে অশ্লীল ও অনৈতিক সংস্কৃতি থেকে দূরে রাখতে পারে। অতএব, কোনো অভ্যাসগত মন্দ সংস্কৃতি দূর করতে হলে আমাদেরকে অবশ্যই মৌলিক বিশ্বাসকে দৃঢ় করতে হবে। অর্থাৎ আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি অকাট্য বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে এবং মরণপণ এই আস্থা রাখতে হবে যে, ইসলামের নিষিদ্ধ বিষয়গুলো আসলেই প্রশ্নাতীতভাবে সঠিক ।

দ্বিতীয়ত, কোনো অনুষ্ঠান বা কার্যক্রম যদি ফিকহের কোনো উসুল দ্বারা অকাট্যভাবে নিষিদ্ধ সাব্যস্ত না হয় অথবা তাতে সন্দেহ না থাকে তবে তা শুধু সুন্নাহে বর্তমান না হওয়ার ফলে হারাম সাব্যস্ত করা যাবে না। হারাম সাব্যস্ত করলে এর বিপরীতে একটি উত্তম পন্থা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সুন্নাতে আছে কি না, তা দেখতে হবে। যদি না থাকে তবে আমাদেরকে দ্বিতীয় পদক্ষেপে যেতে হবে। আর তা হলো ঐ সংস্কৃতির বিপরীতে একটি সুন্নাহর আলোকে উত্তম সংস্কৃতি তৈরি করা, সেই উত্তম পন্থাকে তখন অবশ্যই সম্পূর্ণভাবে সুন্নাহর আলোকেই করতে হবে, যাতে সেখানে সন্দেহের কোন অবকাশ না থাকে। উদাহরণস্বরূপ মুহাররমের দিবসকে (আশুরা) হালালভাবে তথা ইসলামী শরীয়ত সমর্থিত বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে উদযাপন করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে কোনোভাবেই যাতে শিয়াদের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হয়, সেদিকেও কড়া দৃষ্টিপাত থাকতে হবে।

আবার, অভ্যাসগত কিছু আবশ্যিক সংস্কৃতিকে জোরদার করার বিষয়ে আমাদের কাজ করা দরকার। যেমন আমরা সকলেই জানি জামা'আতের সাথে নামাজ আদায় করা ওয়াজিব। তাহলে এই জামা'আতের সাথে নামাজ পড়াকে আমরা সংস্কৃতি বানাতে পারি। যেহেতু বেশিরভাগ মানুষই ফজরের নামাজের সময় নিজের বাসায় থাকে, চাইলেই আমরা অন্তত ফজরের নামাজ একত্রে বাসার নিকটের মসজিদে আদায় করতে পারি। এতে করে সমাজের উঁচুনিচু মানুষের সাথে হৃদ্যতার একটা সুন্দর সম্পর্ক খুব সহজেই গড়ে উঠতে পারে। আজকাল আধুনিক সমাজের ছেলেমেয়ে, যারা সামাজিকতাবোধ থেকে দিন দিন দূরে সরে যাচ্ছে, তাদের মাঝেও সামাজিকতাবোধ জাগ্রত হবে। মানুষে মানুষে মিথষ্ক্রিয়া বাড়বে, এই মিথষ্ক্রিয়া থেকে যোগাযোগ বাড়বে, আর অত্যধিক যোগাযোগের ফলে মানুষের বিষণ্নতারও অনেকখানি নিরসন হবে। কেননা আধুনিককালে বিষন্নতা (ডিপ্রেশন) অনেক বড়ো একটি মানসিক রোগ।

এভাবে করেই আমরা ছোট ছোট আবশ্যিক ইসলামী কাজগুলোকে প্রথমত জোরদার করতে পারি। এই অবস্থান থেকে যখন আমাদের মাঝে ঈমানী চেতনা দীপ্ত হবে, তখন আমরা অন্যান্য নতুন নতুন মুস্তাহাব আমলের দিকে ধীরে ধীরে মনোযোগী হতে পারব; যেমন মুচকি হাসা, কোলাকুলি করা, রাস্তায় পরিচিত-অপরিচিত সকলকে সালাম দেয়া ইত্যাদি। এভাবে করেই একদিন ইসলামী সংস্কৃতির ধাঁচে আমরা একটি উন্নত ইসলামী সভ্যতা গড়ে তুলতে পারব; যে সভ্যতায় নাগরিকগণ হবে বিবেকবান, আদর্শিক, সুশীল, জ্ঞানদীপ্ত ও নৈতিক চেতনার অধিকারী।

লেখক:
শিক্ষার্থী, বি.এ. (সম্মান),
ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ।

Post a Comment

0Comments

Post a Comment (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Ok, Go it!