দৈনন্দিন জীবনে ইসলামী বিধান
প্রত্যেক মুসলমান দৈনন্দিন জীবন-যাপনে এমনকি প্রতিটা মুহূর্তে ইসলামী রীতি-নীতির সাথে আবদ্ধ। প্রতিটা মুসলমানের জন্য নির্ধারিত নীতি রয়েছে। প্রতি ক্ষেত্রে মূলমানের জন্য ইসলামী বিধি-বিধান রয়েছে। ঈমানসহকারে এ বিধি-বিধান যথাযথভাবে মেনে চলতে পারলেই কামিল মুমিন মুসলমান হওয়া যায়। প্রত্যূষে ঘুম হতে জাগ্রত হয়ে বলতে হয়-
الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي أَحْيَانًا بَعْدَ مَا أَمَاتَنَا وَإِلَيْهِ النُّشُورُ
“সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর, যিনি আমাদেরকে মৃত্যু দান করার পর আবার জীবন দান করেছেন এবং তাঁরই দিকে উত্থান পুনঃজীবিত হয়ে।” এরপর হাজত পূরনের জন্য শৌচাগারে প্রবেশ/কালে বাম পা দিয়ে প্রবেশ করতে বলতে হয়-
اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ الْخُبُثِ وَالْخَبَائِثِ
“হে আল্লাহ্! আমি আপনার কাছে দুষ্ট পুরুষ ও নারী জ্বিন হতে পানাহ চাচ্ছি।” হাজত সেরে বের হওয়ার সময় ডান পা দিয়ে বের হয়ে বলতে হয়-
الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي أَذْهَبَ عَنِّي الْأَذَى وَعَافَانِي
“সমস্ত প্রশংসা ওই আল্লাহর, যিনি আমার থেকে কষ্ট দায়ক বস্তু দূরীভূত করেছেন এবং আমাকে শান্তি দান করেছেন।” এর পর মিসওয়াক করবেন। এরপর ওযু করবেন। ওযু আরম্ভ করতে বলবেন-
بِسْمِ اللهِ الْعَلِيُّ الْعَظِيمِ وَالْحَمْدُ للهِ عَلَى دِينِ الإِسْلَامِ الإِسْلَامُ حَقٌّ وَالْكُفْرُ بَاطِلُ الإِسْلَامُ نُورُ وَالْكُفْرُ ظُلْمَةٌ
হাত, মুখ মণ্ডল ও পা ধোয়া এবং মাথা মাসেহ করার মতো ৪টি ফরয এবং ৯টি সুন্নাত ও ৬টি মোস্তাহাব আদায় করে ওযু সম্পন্ন করে ওযুর অবশিষ্ট পানি দাঁড়িয়ে পান করে এ দোয়া পড়বেন-
اللَّهُمَّ اجْعَلْنِي مِنَ التَّوَّابِينَ وَاجْعَلْنِي مِنَ الْمُتَطَهِّرِينَ وَاجْعَلْنِي مِنْ عِبَادِكَ الصَّالِحِينَ
“হে আল্লাহ্! আমাকে তাওবাকারীদের অন্তর্ভুক্ত করুন, আমাকে পবিত্র লোকদের মধ্যে শামিল করুন। আমাকে আপনার নেক বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করুন।" এরপর ফজরের নামায আদায়ের জন্য মুসাল্লায় দাঁড়িয়ে বলবেন-
إِنِّي وَجَهْتُ وَجْهِيَ لِلَّذِي فَطَرَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ حَنِيفًاتٌ وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ
ফজরের সুন্নাত আদায় করে জামাতসহকারে ফজরের ফরয আদায় করবেন। জামাতে নামায আদায়ের জন্য মসজিদের দিকে রওয়ানা হলে প্রতি কদমের বিনিময়ে সাওয়াব পাওয়া যায়। মসজিদে প্রবেশের সময় ডান পা দিয়ে প্রবেশ কালে বলবেন-
بسْمِ اللهِ وَالصَّلَاةُ والسلام على رسولِ اللَّهِ اللَّهُمَّ افْتَحْ لِي أَبْوَابَ رَحْمَتِكَ
জামাতে ফজরের দু'রাকাত ফরয নামায আদায় করা পুরুষের জন্য সুন্নাতে মুয়াক্কাদা। মহিলারা এ নামায ঘরে একাকী আদায় করবেন। পুরুষেরা এশা ও ফজরের ফরজ নামায জামাত সহকারে আদায় করলে তার আমল নামায় সারা রাত জাগ্রত থেকে ইবাদতকারী হিসেবে লিপিবদ্ধ করা হয়। ফজরের নামায আদায় করে যতক্ষণ পর্যন্ত মুসল্লায় (জায় নামাযে) বসে থাকবেন, একজন ফেরেশতা তার জন্য দো'আ করে বলতে থাকেন-
اللَّهُمَّ اغْفِرْ لَه اللَّهُمَّ ارحمه
"হে আল্লাহ্! তাকে মাফ করে দিন। হে আল্লাহ্ । তাকে দয়া করুন।" এ দো'আ ততক্ষণ পর্যন্ত করতে থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত সে ওযু ভঙ্গ না করে। ফজরের নামায পড়ে মুসল্লায় বসে থেকে দুরূদ শরীফ ও তাসবীহ-তাহলীল আদায় করতে থাকবেন। সম্পূর্ণরূপে সূর্য উদিত হলে কমপক্ষে দু'রাকাত সালাতুল ইশরাক আদায় করবেন। এরপর বাম পা দিয়ে মসজিদ হতে বের হওয়ার সময় বলবেন-
اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ من فَضْلِكَ
“হে আল্লাহ্! আমি আপনার থেকে আপনার অনুগ্রহ চাই।" অর্থাৎ রিজিকের সন্ধানে আপনার ঘর-মসজিদ হতে বের হচ্ছি। যদি রিজিক তালাশের প্রয়োজন না হতো তাহলে সর্বদা আপনার ঘরে অবস্থান করে ইবাদত করতাম। আর রিজিক তালাশ করছি ওই রিজিক খেয়ে শক্তি সঞ্চয় করে আবার যেন আপনার ইবাদত করতে পারি। শক্তি সঞ্চয় করে ইবাদত করার নিয়্যতে রিজিক তালাশের জন্য যতক্ষণ মাঠে-ময়দানে, অফিসে আদালতে, দোকানে, রাস্তায় ঘাটে কাজ করবেন ততক্ষণ পর্যন্ত প্রতিটা নিঃশ্বাস, কলমে, প্রতিটি মুহূর্তে সাওয়াব পাবেন। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, একজন বিবেকবান বালেগ ও তাহেরা (হায়েজ-নেফাস হতে মুক্ত মহিলা) মুসলমানের দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায়ের জন্য পাঁচটি বিশেষ ওয়াক্ত রয়েছে। ওয়াক্ত শুরু হলেই এমন প্রত্যেক মুসলমানের উপর মহান আল্লাহ্ তা'আলার পক্ষ হতে উক্ত ওয়াক্তের নামায (ফরয) আদায়ের জন্য নির্দেশ হয়। সে যদি ওয়াক্তের ভেতর নামায (ফরয) আদায় করে তাহলে আল্লাহ্ তা'আলার আদেশটা পালন করলো। আর যদি নামায (ফরয) আদায় না করে তাহলে সে সরাসরি আল্লাহ্ তা'আলার আদেশ অমান্য করে নাফরমান হলো। অতএব, সোবহে সাদেক আল্লাহ্ তা'আলার পক্ষ হতে প্রত্যেক বিবেকবান বালেগ মুসলমানের প্রতি নির্দেশ আসে তুমি ফজরের নামায (ফরয) আদায় কর। সুতরাং সে যদি সোবহে সাদেক হতে সূর্যোদয়ের পূর্বে পর্যন্ত সময়ে ফজরের দু'রাকাত ফরয নামায আদায় করে তাহলে সে আল্লাহ তা'আলার আদেশটা পালন করলো । আর আদায় না করলে সে নাফরমানি করলো। হাদীসে পাকে এসেছে-
كل النَّاسِ يَغْدُو، قَبَائِعُ نَفْسَهُ، فَمُعْتِقُها أَو مُوبِقها
"প্রত্যেক মানুষ ভোরে জাগ্রত হয়। ফলে নিজের আত্মার বিক্রেতা হয়। হয়তো সে নিজেকে জাহান্নাম হতে মুক্ত করে অথবা নিজেকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করে। সে যদি সোবহে সাদেকের সময় ঘুম হতে জাগ্রত হয়ে ফজরের নামায পড়ে তাহলে নিজেকে জাহান্নাম হতে রক্ষা করলো। আর যদি ফজরের নামায না পড়ে তাহলে নিজকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করলো। এভাবে যোহরের ওয়াক্ত আরম্ভ হলে যোহরের নামায আদায়ের আদেশ আল্লাহ্ তা'আলার পক্ষ হতে হয়। অনুরূপ আসর, মাগরিব ও এশার ওয়াক্ত আরম্ভ হলে উক্ত ওয়াক্ত সমূহের নামায (ফরয) আদায়ের আদেশ হয়। ওয়াক্ত আরম্ভ হওয়ার পর বিলম্ব করে শেষ ওয়াক্তে এ নামায আদায়ের সুযোগ আছে। তখন শেষ ওয়াক্তে আদায় করাটা নির্দিষ্ট হয়ে যায়। ফলে কোন ব্যক্তি শেষ ওয়াক্তে নামাযের আহল (উপযুক্ত) হলে যেমন কাফের মুসলমান হলে, কিংবা হায়েজ ওয়ালী মহিলা পাক হলে এবং শুধু তাকবীর তাহরিমা বলার সময় থাকলে উক্ত ওয়াক্তের নামায কাযা করতে হবে। সে জন্যেই কোন নারী শেষ ওয়াক্তে ঋতুবর্তী হয়ে গেলে তাকে ওই ওয়াক্তের কাযা করতে হবে না, যদি প্রথম ওয়াক্ত আদায় না করে। জাওয়াহেরুল ফিকহ, পৃষ্ঠা ৬ এবং আম কুতুবুল ফিকহ।
অতএব উপরের বর্ণনা দ্বারা এ বিষয় সুস্পষ্ট হলো যে, একজন মুসলমান দৈনন্দিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের আদেশে আদিষ্ট। এ পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের সাথে আবদ্ধ। এ নামায থেকে মুক্ত নয়। কোন অমুসলিমের উপর শরীয়তের বিধি বিধান ততক্ষণ পর্যন্ত বর্তায় না, যতক্ষণ না সে ঈমান এনে মুসলমান হয়। তার উপর সর্বপ্রথম ফরয হচ্ছে ঈমান আনা। আর ঈমান না আনলে তাকে কুফরের কারণে চিরদিন দোযখের শাস্তি ভোগ করতে হবে।
এক মুসলমান আরেক মুসলমানকে দেখলে সালাম বলবে-
السلام عليكم ورحمة الله
অপর মুসলমান উত্তরে বলবে-
وعليكم السلام ورحمة الله
এরপর এ বলে মোসাফাহা করবে-
يَغْفِرُ الله لَنَا وَلَكُمْ
"আল্লাহ্ তা'আলা আমাকে এবং আপনাকে ক্ষমা করুন।”
এবং পরস্পর আলিঙ্গন করবে এবং বলবে-
اللَّهُمَّ زِدْ مُحبَّةِ اللَّهِ وَرَسُولِهِ
“হে আল্লাহ্! আপনি আমাদের মধ্যে ভালোবাসা আল্লাহ্ ও রাসূলের ওয়াস্তে বাড়িয়ে দিন।” এ সালামের মাধ্যমে পরস্পরের মনোমালিন্য দূর হবে। পরস্পরের মধ্যে ভালোবাসা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে। মুসলমান খেতে বসলে থালার নিজের দিক থেকে খাবে। মাঝখান থেকে খাবে না। যেহেতু মাঝখানে বরকত নাযিল হয়। পাত্রের মধ্যে একটি দানাও অবশিষ্ট রাখবে না। পত্রটি চেঁটে খাবে। কেননা হাদীস শরীফে হুযূর-ই আকরাম বলেন, কোন দানার মধ্যে শেফা আছে তা তুমি জানোনা। ভাতকে ধোয়া কিংবা মাসেহ করার পূর্বে আঙ্গুলগুলো নিজে চাঁটবেন কিংবা অপর (ছাত্র, ছেলে-মেয়ে, মুরিদ) দ্বারা চাটাবেন। খাবার শুরুতে বলবেন--
بسْمِ اللهِ وَعَلى بَرَكَة الله
এবং খানার পর নিজের ঘরে খেলে বলবে-
الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي أَطْعَمَنَا وَسَقَانَا وَجَعَلَنَا مُسْلِمِينَ اللَّهُمْ أَطْعِمْ مَنْ أَطْعَمَنِي وَاسْقِ مَنْ سَفَانِي
অন্য কারো ঘরে খাবার খেলে বলবেন-
"হে আল্লাহ্! যিনি আমাকে খাওয়ালেন আপনি তাকে খাওয়ান এবং যিনি আমাকে পান করিয়েছে আপনি তাকে পান করান।" ডান হাতে খাবে এবং ডান হাতে পান করবে। কোন সুখবর শুনলে (আলহামদুলিল্লাহ) বলবেন। কোন দুঃসংবাদ শুনলে- (ইন্না-লিল্লাহ) বলবেন, কোন আশ্চর্য জনক খবর শুনলে বলবেন সুবহানাল্লাহ। উপরে উঠার সময় (আল্লাহু আকবার) নিচে অবতরণ করার সময় (সুবহানাল্লাহ) বলবেন। এভাবে প্রতিটি মুসলমান সব সময় আল্লাহর জিকির করবে।
হাদীসে কুদসীতে এসেছে-
أنا مع عيدي ما تحركت بي شفتاه
আমি আমার বন্দার সাথে থাকি যতক্ষণ আমাকে কেন্দ্র করে তার দু'ঠোঁট নাড়া- চড়া করে। এভাবে একজন মুসলমান সবসময় ভালো কথা বলবে, ভালো কথা বলার না থাকলে চুপ থাকবে। হাদীসে পাকে এসেছে-
مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ فَلْيَقُلْ خَيْرًا أَوْ لِيَصْمُتْ
মুসলমান রমজান মাস পেলে প্রতিদিন সোবহে সাদেক হতে সূর্যান্ত পর্যন্ত সময়ে পানাহার, স্ত্রী সহবাস ও যাবতীয় অশালীন বিষয় বর্জন করার মাধ্যমে রোযা পালন করা ফরযে আইন। এ রোযার সাথে সে আবদ্ধ। এর থেকে মুক্ত নয়। অনুরূপ নেসাব পরিমাণ মালের মালিক হলে যাকাত আদায় করা ফরয। সামর্থবান হওয়ার সাথে সাথে হজ্ব করা ফরয। ঈদুল ফিতরের সোবহে সাদেকের সময় নেসাব পরিমাণ মালের মালিক হলে ফিতরা আদায় করা ওয়াজিব। ঈদুল আযহার দিন এবং পরবর্তী দু'টি নেসাব পরিমাণ মালের মালিক হলে কুরবানী করা ওয়াজিব। মুখমণ্ডলে দাড়ি গজালে এবং মুষ্টি পরিমান রাখা পুরুষের জন্য সুন্নাতে মুয়াক্কাদা । নখ কাটা, নাভির নিচের কেশ পরিষ্কার করা, বগলের নিচের বেশ পরিষ্কার করা মিসওয়াক করা গোফ কাটা সুন্নাতে মুয়াক্কাদা। এগুলো চল্লিশ দিনের বেশী হওয়া মাকরূহে তাহরিমি। [ফতোয়ায়ে শামী
মুমিনের উচ্ছিষ্ট। আরেক মুমিনের জন্য শেফা। এক মু'মিনের উপর আরেক মু'মিনের ৬টি হক রয়েছে- ১. সালামের জবাব দেয়া, ২. অসুস্থ হলে সেবা করা, ৩. মৃত্যু বরণ করলে জানাযা ও দাফন কাফনে শরীক হওয়া, ৪ দাওয়াত দিলে গ্রহণ করা, ৫. উপস্থিত ও অনুপস্থিত সময়ে কল্যাণ কামনা করা, ৬. হাচি দিলে জবাব দেওয়া। এভাবে একজন মুসলমান প্রতিটা পর্বে, ক্ষেত্রে, মুহূর্তে, কদমে, ইসলামী রীতি-নীতি, বিধি-বিধান, সংস্কৃতি, আইন-কানুন, সভ্যতা, আদব-কায়দা, আখলাক-চরিত্র ও আদর্শের সাথে সম্পর্কযুক্ত এগুলো মেনে চললে কামিল (পূর্ণাঙ্গ) মুসলমান হতে পারবেন। এভাবে প্রত্যেক মুমিনের দৈনিক জীবনেরর সাথে সংশ্লিষ্ট প্রতিটা কাজের ইসলাম সম্মত বিধি- বিধান রয়েছে। ওইগুলো যথাযথভাবে মেনে নিয়ে আমল করা প্রয়োজন। কেউ এমনটি করলেই তিনি ঈমান ও ইসলামের স্বাদ পাবেন। তিনি হবেন একজন অনুসরনীয় ও অনুকরণীয় আদর্শবান মুসলমান।