ইসলামি অর্থনীতির রূপরেখা - Outline of Islamic Economics

Mohammed Ahsan
0

 ইসলামি অর্থনীতির রূপরেখা

মুহাম্মদ আছেম উল্লাহ ইয়াছের

ইসলামি অর্থনীতির রূপরেখা - Outline of Islamic Economics


আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন,

وما خلقت الجن والانس الا ليعبدون

মানে মানবজাতিকে এ জমিনে প্রেরণের মূল উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর ইবাদত করা। আর স্রষ্টার এ পরিপূর্ণ ইবাদতে প্রয়োজন সুস্থ দেহ ও সুস্থ মন, এজন্য মৌলিক প্রয়োজনীয় চাহিদা হলো খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ইত্যাদি। এসব মৌলিক চাহিদা পূরণে অবশ্যম্ভাবীভাবে প্রয়োজন অর্থ ও সম্পদ। এবং অর্থ-সদ ঐসব মৌলিক চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে তিনটি বিষয়ের সম্মুখীন হয় ; উৎপাদন, ভোগ, বণ্টন। এই তিনটি বিষয়কে সামনে রেখে অর্থ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার নামই অর্থনীতি।

আধুনিক অর্থনীতির মূল ভাষ্য হচ্ছে, “মানুষের সম্পদ সীমিত, কিন্তু চাহিদা অফুরন্ত। ইসলাম এ-মতের সাথে দ্বিমত পোষণ করে বলে, “একজন মানুষের অফুরন্ত চাহিদা থাকা তাকে স্বার্থপর করে তুলতে পারে। তাই চাহিদা সীমিত করে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করাই ইসলামি অর্থনীতির প্রশ্ন হলো ইসলামি অর্থনীতি বিষয়টি কী। মূল উদ্দেশ্য।”

আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইসলামী অর্থনীতিবীদ ডঃ এম উমর চাপরা বলেন, ইসলামী অর্থনীতি জ্ঞানের সেই শাখা যা ইসলামের শিক্ষার সাথে সঙ্গতি রেখে দুষ্প্রাপ্য সম্পদের বন্টন ও বরাদ্দের মাধ্যমে এবং ব্যক্তির স্বাধীনতা অযথা খর্ব ও সামষ্টিক অর্থনীতি এবং পরিবেশগত ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি না করে মানবকল্যাণে সহায়তা করে।

এককথায়, ইসলামি কৃষ্টি ও তামাদ্দুন সমৃদ্ধ যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে তাই ইসলামি অর্থনীতি। প্রতিটি অর্থব্যবস্থা বা অর্থনীতির মতো ইসলামী অর্থনীতির কিছু মূলনীতি বা মূল বিষয় রয়েছে। কোরআন ও হাদিসের আলোকে মোটা সাতটি বিষয়কে ইসলামী অর্থনীতির মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়-

১. অর্থোপার্জনের ক্ষেত্রে হালাল-হারামের পার্থক্য বিবেচনা

২. সকল কর্মকাণ্ডেই শরীয়াহ্-এর বিধান মেনে চলা 

৩. সম্পদ কুক্ষিগত করতে নিষেধাজ্ঞা

৪. আদল ও ইহসানের ভিত্তিতে ব্যয়-বণ্টনের নির্দেশ

৫. সুদ মুক্ত হওয়া

৬. ব্যক্তির সম্পদে সমাজের অধিকার প্রতিষ্ঠা

৭. ভারসাম্যপূর্ণ জীবনযাপন

যাকাতকে বলা হয় ইসলামি অর্থনীতির প্রাণ ও অর্থব্যবস্থার প্রধান ভিত্তি। এর গুরুত্ব অনুধাবনের জন্য আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে ৩২ বার যাকাত প্রদানের কথা উল্লেখ করেছেন। যাকাত মূলত ধনীদের থেকে নিয়ে গরিবদের মাঝে বণ্টন করা। যাকাতের অর্থ গরিব, মিসকিন, অসহায়, ফকিরদের মাঝে বণ্টন করলে ধনী- গরিবের মাঝে বৈষম্যের সম্পর্ক থাকে না । ইসলামি শরীয়তানুসারে যেসব দ্রব্যের উপর যাকাত ধার্য করা হয়েছে তা হচ্ছে- ১. ব্যাংক / হাতে সঞ্চিত / জমাকৃত অর্থ। ২. সোনা, রূপা এবং সোনা-রূপা দিয়ে তৈরি অলংকার। ৩. ব্যবসায়ের পণ্যসামগ্রী । ৪. জমির ফসল। ৫. খনিজ উৎপাদন। ৬. সব ধরনের গবাদি পশু। যাকাতের সর্বনিম্ন পরিমাণ হচ্ছে ৪০ ভাগের ১ ভাগ বা শতকরা ২.৫%। তবে যাকাতের হার দ্রব্য থেকে দ্রব্যে ভিন্ন হয়।

আল্লাহ তায়ালা যাকাতের সম্পদ কাদের মর্ধে বণ্টিত হবে সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন। যেমন আল্লাহ তায়ালা সূরা তওবার ৬০ নং আয়াতে বলেন, ৮টি শ্রেণির মানুষ যাকাত পাওয়ার হকদার। তারা হচ্ছে-

০১. দরিদ্র ০২. অভাবী ব্যক্তি ০৩. যাকাত আদায়ে নিয়োজিত কর্মচারী ০৪. নও মুসলিম ০৫. ক্রীতদাস মুক্তি ০৬. ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি ০৭. আল্লাহর পথে ব্যয় ০৮. মুসাফির যাকাতের মূখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে কতিপয় ব্যক্তির হাতে সম্পদ কেন্দ্রীভূত হতে না দেয়া। ইসলাম সামাজিক শ্রেণি বৈষম্যকে কেবল নিন্দাই করে না, বরং তা দূরীভূত করার পদক্ষেপও অবলম্বন করতে বলে

জনসাধারণের উপর অর্থনৈতিক জুলুমকে পাকাপোক্ত করার সবচেয়ে কার্যকরী ও মোক্ষম হাতিয়ার হলো 'সুদ'। তাই ইসলাম সুদ ও সুদভিত্তিক সমস্ত কারবার ও লেনদেন চিরকালের জন্য হারাম করে দিয়েছে। আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা দেন,

احل الله اليع وحرم الربا

“আল্লাহ তায়ালা ব্যবসাকে হালাল ও সুদকে হারাম করে দিয়েছেন।” (২:২৭৫) রাসুল সুদখোর, সুদ দাতা, সুদের সাক্ষী ও সুদের কাগজে স্বাক্ষরকারী ব্যক্তিদের অভিসম্পাত করেছেন।

সুদের মাধ্যমে ধনী আরও ধনী ও দরিদ্র আরও দরিদ্র হতে থাকে। এবার আসুন জেনে নেয়া যাক 'সুদ কী সুদমুক্ত অর্থব্যবস্থা প্রবর্তনে ইসলাম কয়েকটি পদক্ষেপ নিয়েছে। যেমন :

১. মুদারাবা ২ বায়ে সালাম ৩. বাকিতে ক্রয়বিক্রয় ৪. কর্জে হাসানা ৫. যাকাত ইসলামি শরীয়তের নির্দেশনার আলোকে যে বিভাগটি ইসলামি রাষ্ট্রের আয়-ব্যয়ের খাতসমূহের নির্বাহ ও পরিচালনার গুরুদায়িত্ব পালন করে তাকে বায়তুল মাল বলে। বায়তুল মালের ইসলামি শরীয়তানুযায়ী অর্থ সংস্থান বা রাজস্বের উৎস:

• যাকাত ও সদকাতুল ফিতর • ওশর উৎপাদিত ফসলের এক-দশমাংশ • খারাজ; ভূমি বা কৃষির উপর আরোপিত রাজস্ব কর • ফাই; লড়াই ব্যতীত অমুসলিমদের থেকে অর্জিত সম্পদ। • গণিমতের মাল ও জিজিয়া; অমুসলিমদের জমি থেকে ইত্যাদি।

এসব খাত থেকে সম্পদ অর্জিত হয়ে বায়তুল মাল বা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হবে। ইসলাম নিম্নবর্ণিত খাতে ব্যয় করার জন্য তাগিদ দিয়েছে।

• রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারী কর্মচারীদের বেতন প্রদানের ক্ষেত্রে ও বন্দী ও কয়েদিদের ভরণপোষণের ক্ষেত্রে • লা-ওয়ারিশ ও এতিম শিশুদের প্রতিপালনের ক্ষেত্রে অমুসলিমদের আর্থিক নিরাপত্তা প্রদানের ক্ষেত্রে ও করজে হাসানা প্রদানের ক্ষেত্রে

• রাষ্ট্রীয় ব্যবসায়িক কার্জাদি সামলানোর ক্ষেত্রে ও সামাজিক কল্যাণ সাধনের ক্ষেত্রে ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থা বলতে শরীয়ত মোতাবেক আর্থিক ব্যবস্থার উপর নির্ভর করে গড়ে উঠা ব্যাংক ব্যবস্থা। তবে পরিপূর্ণ ইসলামাইজড করতে হলে তা দুটি মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত হতে হবে।

১. লাভ-লোকসানের ভাগিদার হওয়া।

 ২. সুদভিত্তিক লেনদেন নিষিদ্ধ হওয়া।

সামরিক, শিক্ষা ও অর্থনীতি ; এতিনটি দিক থেকে যে রাষ্ট্র যত শক্তিশালী সে রাষ্ট্র বিশ্বের বুকে তত শিরোধার উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। বর্তমান বিশ্বের দিকে লক্ষ্য করলেই আমরা বিষয়টি বুঝতে পারি। মুসলিমদের এমন শোচনীয় অবস্থায় যদি মুসলিম বিশ্ব আবারো মাথা তুলে দাঁড়াতে চায়, তাহলে তাদের ইসলামি অর্থব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কারণ, এর মূল লক্ষ্যই হচ্ছে জুলুম ও নিপীড়নমুক্ত একটি সুন্দর ও সুষম সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। তাই ইসলামি অর্থব্যবস্থার বিকল্প কিছুই হতে পারে না।

লেখক:
শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। 
সাবেক শিক্ষার্থী, জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদ্রাসা।

Post a Comment

0Comments

Post a Comment (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Ok, Go it!