কাশেম ও তার ছেলে
মুহাম্মদ ইব্রাহী

- তো আপনারা জন্মদিন পালন করেন। সেদিন তো তিনি ইন্তেকালও করেছেন। তাহলে মৃত্যু দিন পালন করেন না কেন?
- আরে ভাই, যে নবী হায়াতুন্নবী, সে নবী কি মারা যেতে পারেন? যে নবীদের দেহ - ভক্ষণ করা আল্লাহ পাক মাটির জন্য হারাম করেছেন, যে নবীদের রওজা মোবারকে জিন্দা রেখেছেন, তাঁদের রিজিক দেন, সেখানে নামাজ পড়েন, যে নবীজি মদিনার রওজায় শুয়ে উম্মতের ভাল আমল দেখে আনন্দিত হোন, খারাপ কাজ দেখলে অশ্রু ঝড়ান, কিয়ামতের ময়দানে যিনি উম্মতদের জন্য শাফায়াত করবেন, সে নবীজিকে আপনি মৃত বলে মৃত্যু দিবস পালন করতে বলেন? এই আপনার আকল? আচ্ছা মানলাম, একজন মানব হিসেবে তিনি দুনিয়া থেকে ইন্তেকাল করেছেন। কিন্তু তাই বলে উনার মৃত্যু বা শোক তো পালন করা যায় না। ইসলামে তো তিনদিনের বেশি শোক পালন করা জায়েজ নেই, স্বয়ং হুজুর ( সা: ) তা থেকে নিষেধ করেছেন।
-তাহলে আপনারা যে জুলুস করেন। জুলুসে নাচানাচি করেন। এসব কই পাইলেন? - কি যে বলেন মুরব্বি। জুলুস তো আসমানের ফেরেশতারা শিক্ষা দিয়েছে। নবীজির আগমনের দিন আসমানের ফেরেশতারা দলে দলে মা আমেনার কুঁড়েঘরে এসে আনন্দ উল্লাস করেছে। খানায়ে কাবা, মক্কার গাছপালা, মদিনার পশু-পাখি, আরবের তৃণলতা সেদিন খুশিতে আত্মহারা হয়েছে। সমুদ্র গর্জন তুলেছিল নবীপ্রেমের, সাগরের মাছ জানিয়েছে মারহাবা। সেখান থেকেই তো জুলুসের শিক্ষা। হুজুরের আগমনের আনন্দ র্যালির দীক্ষা। এখন বিশ্বের ৫২ টির অধিক মুসলিম দেশে ১২ রবিউল আউয়াল রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারিভাবে এই জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপিত হয়। বিশ্বের ১২০ টির অধিক অসাম্প্রদায়িক দেশে, বাংলাদেশের আনাচে- কানাচে, পাড়ায়-মহল্লায় এ জুলুস হয়। ১২ রবিউল আউয়াল চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি শিক্ষা নিকেতন জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়ার ময়দান থেকে হুজুর কেবলার নেতৃত্বে বিশাল জুলুস বের হয়। ২০ লক্ষাধিক ধর্মপ্রাণ মুসলমান সেখানে অংশগ্রহণ করে তাওহীদ এবং রিসালাতের স্লোগান তোলে, নবীপ্রেমের নাত-গজলের মোহনা জাগায়, মাঠে বসে লাখো প্রেমিক দেশসেরা আলেমদের ধর্মীয় বয়ান শুনে। একটা প্রেমের আবহ তৈরি হয় পুরো চট্টগ্রাম জুড়ে। এসবই তো হয়! জুলুসে প্রেমের মেলা হয়, ইশকের হৃদয় দোলা হয়। আপনি এখানে নাচানাচি কই পাইলেন? তাবলিগে গিয়া আপনারা ইয়াবা ব্যবসা আর দুই গ্রুপে মাথা ফাটাফাটি করেন বলে আমাদেরও এমন মনে করে ভুল করবেন না। আপনারা আসেন। জুলুসে অংশ নেন । দেখেন সেখানে কি হয়। কি ভালবাসার মিলনমেলা চলে।
- আপনারা ওখানে বিদেশী পীর এনে মিছিল করেন কেন?
- এই যে মিয়া ভাই, আরেকটা ভুল বললেন। পীর তো বিদেশী হইতে পারে না। মু'মিন তো সব এক জাত। আল্লাহ তো কুরআনে সেটাই বলেছেন যে, “ঈমানদারগণ পরষ্পর ভাই।” রাসুলে পাক বিদায় হজ্বের ভাষণে স্পষ্ট উচ্চারণ করেছেন “মুমিনরা এক জাত। এক গোষ্ঠী। পৃথিবীর যেখানেই থাকুক তারা পরস্পর ভাই।" আর আপনারা এখানে ভাগাভাগি শুরু করে দিলেন! মু'মিনদের জন্য আবার দেশ বিদেশ হতে পারে নাকি! এটা তো কুরআন বিরোধী কথা, হাদীস অস্বীকারেরও নামান্তর। আপনাদের এসব বাকওয়াজ শুনেই তো আল্লামা ইকবাল বলেছিলেন “চীন আওর আরব হামারা হিন্দুস্থান হামারা, মুসলিম হ্যায় হাম ওয়াতান হ্যায় সারা জাহান হামারা।” আর ধরে নিলাম ভূখণ্ডগত হিসাবে হুজুর কেবলাগণ বিদেশী। যেহেতু ওনাদের জন্মভূমি পাকিস্তান। তাহলে কী দ্বীন প্রচারে, নবীপ্রেমের দাওয়াত নিয়ে ওনারা এ দেশে আসতে পারবেন না? আর আওলাদে রাসুলদের আপনি বিদেশী বলেন তাহলে তো এটা নবীবিদ্বেষী এবং ঈমানবিদ্বেষী কথা হবে। কারণ নবীজির দেশও এদেশের হিসেবে বিদেশ। কুরআনও সেদেশের, আরবি ভাষায়। অন্যান্য নবীরাও বিদেশী । কোনো নবীর আগমন এ দেশে হয়নি। বড় বড় হাদীসগ্রন্থ বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযীর রচয়িতারাও এদেশের নন। তাহলে তো তাদের বুখারী-মুসলিম এদেশে পড়ানো যাবে না!
- আপনারা কিসের সুন্নি? আপনাদের মধ্যে কোন সুন্নাতই নাই ।
- আরে ভাই, সুন্নাত থাকলেই সুন্নি, না থাকলে মুন্নী; বিষয়টা তো সেরকম না। সুন্নি কাকে বলে সেটার পারিভাষিক পরিচয় আপনাকে আগে জানতে হবে। সুন্নি হলো আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত এর সংক্ষিপ্ত রূপ। যারা আকিদাগতভাবে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত এর অনুসরণ করে তাদেরকে এক কথায় সুন্নি বলে। রাসুলে পাক বলেছেন “আমার উম্মত ৭৩ দলে বিভক্ত হবে। তন্মধ্যে এক দল জান্নাতে যাবে। সে দল তারা; যাদের মধ্যে আমি এবং আমার সাহাবারা থাকবে।” আল্লামা মোল্লা আলী কারী (রা) তাদের পরিচয় দিয়ে মিরকাত শরহে মিশকাতে বলেছেন "কোন সন্দেহ নেই, কোন সংশয়
নেই যে সে দল 'আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত'।” আ'লা হযরত বলেছেন- “আহলে সুন্নাতের তরী পার হয়ে যাবে ভয় নাই, পথ দেখানো তারকা তাদের আসহাবে রাসুল, আরোহী নৌকা হলো হুজুরের আওলাদে পাক । এরাই সুন্নি। যারা আকিদায় পরিশুদ্ধ, আমলে হস্তসিদ্ধ, চেতনায় জাগ্রত, নিবেদিত প্রেমের ভাবনায়।
- তো তারা সুন্নাত পালন করে না কেন?
- পালন করে না আপনাকে কে বললো? তারা আপনাদের মতো লোক দেখানো সুন্নাতের মিসওয়াক নিয়ে ইস্তেঞ্জা করে করে দাঁত মাজে না বলে, সিজদা দিয়ে কপাল ঘষে কপালে আলিফ লায়লার দাগ তুলে না বলে আপনি তাদের সুন্নাত পালন করে না বলতে পারবেন না। সুন্নি মসজিদগুলো দেখুন, কাতার ভরপুর । শবে কদর, শবে বরাতে দেখুন, আপনারা যখন ঘরে নাক ডাকেন তারা তখন রাত জেগে ইবাদত করে মুখে দাঁড়ি, সুন্নাতি লেবাস, আচরণে পরহেজগারিতার জন্য সুন্নিরা অনন্য। হুদাই তাদেরকে ব্লেইম করে ফায়দা কী ভাই?
হুজুর অনেক যুক্তি দেয়ার চেষ্টা করলেন। কোন যুক্তিতে সুবিধা করতে না পেরে প্রথমে বেশ রেগেমেগে আগুন হয়েছিলেন। কাশেম বললো, হুজুর! ভেবেছিলাম আজকে আপনাকে টেনে দিব। আমার সামনে আউল-ফাউল বকে কেউ স্বাভাবিক ফিরে যেতে পারে না। হয় টেনে দিছি, নয় গুতায় দিছি। আজকে আপনাকে গুতাবো না। শুধু দাওয়াত দিলাম জশনে জুলুসের। ১২ রবিউল আউয়াল আপনি আসেন জামেয়ার ময়দানে। একসাথে জুলুস করি। কথায় কথায় টেনে দেয়ার লোক কাশেমের মায়ার আমন্ত্রণ পেয়ে হুজুর এবার বেশ নম্র হলেন। মুহূর্তে তার অন্তর পরিবর্তন হয়ে গেলো। আমাকে বললেন, ভাইজান, হাত দু'টা দেন। এসব আউল-ফাউল দলে আর থাকবো না। এরা ভুল বুঝিয়ে আমাদের এতদিন পথভ্রষ্ট করে রেখেছেন। আপনার হাত ধরে আজকে সুন্নিয়তে দাখিল হবো। আমি রবের শোকরিয়া জ্ঞাপন করলাম, মুচকি হাসলাম। বললাম, হুজুর, আমার হাত নয়। ১২ রবিউল আউয়াল জামেয়ায় আসেন। আপনি সরাসরি আওলাদে রাসুলের হাতে হাত দিয়ে সুন্নিয়তে পদার্পণ করবেন, কাদেরিয়া তরিকায় দাখিল হবেন, সিরিকোটের বাগানের সৈনিক হবেন, আ'লা হযরতের মসলকের যোদ্ধা হবেন, নবীপ্রেমের ঘোড়ার সাওয়ারী হবেন।
লেখক: