মুক্তিযুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন রাষ্ট্র ও ব্যক্তির অবস্থান ও ভূমিকা
কাজ-১: বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত তথ্য অনুসন্ধান।
থিম-৩: মুক্তিযুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন রাষ্ট্র ও ব্যক্তির অবস্থান ও ভূমিকা |
অনুসন্ধানের প্রশ্ন: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন রাষ্ট্র ও ব্যক্তির অবস্থান ও ভূমিকা কেমন ছিল?
প্রশ্নে যে বিষয়বস্তুগুলো রয়েছে: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কোন কোন দেশ বা রাষ্ট্র অবস্থান নেয়? কোন কোন বিদেশী ব্যক্তি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ইতিবাচক ভূমিকা রাখেন?
তথ্যের উৎস: পাঠ্যপুস্তক, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বই, স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা, ইন্টারনেট।
তথ্য বিশ্লেষণ: উল্লেখিত উৎস থেকে আমরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা রাখা বিভিন্ন রাষ্ট্র ও ব্যক্তি সম্পর্কে জেনেছি। এই তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করে নিচে উপস্থাপন করা হলো:
তথ্য উপস্থাপন:
মুক্তিযুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন রাষ্ট্র ও ব্যক্তির অবস্থান ও ভূমিকা
১৯৭১ সালে যখন বাঙালিরা একটি অনিবার্য মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন, তখন এ যুদ্ধের ন্যায্যতা অনুধাবন করতে পেরে বিশ্বের অনেক রাষ্ট্র, সংস্থা এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বাঙালিদের পক্ষে অবস্থান করেন। তাঁদের ইতিবাচক ভূমিকার কারণে বাংলাদেশ সারাবিশ্ব ব্যপী একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের পক্ষে জনমত গঠন করতে সক্ষম হয়। নিচে এঁদের সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:
১. ভারত: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সূচনাতেই সৃষ্টি হয় শরণার্থী সমস্যা। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর নৃসংশতায় লাখ লাখ মানুষ গৃহহারা হয়। ২৫শে মার্চের মধ্যরাতে বাঙালি নিধনযজ্ঞ শুরু হলে প্রাণভয়ে ও নিরাপত্তার সন্ধানে লাখ লাখ মানুষ বিভিন্ন পথে পাশের দেশ ভারতের সীমান্তবর্তী গ্রাম ও শহরগুলোতে আশ্রয় নেয়। ১৯৭১ সালের ৫ই ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী শরণার্থীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৯৮ লাখ ৯৯ হাজার ৩০৫ জন। আর ভারতও তখন মহানুভবতার পরিচয় দিয়ে বিশাল সংখ্যক শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে শরণার্থী সমস্যা মোকাবিলায় মূল ভার বহনকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে ভারত।
২. সোভিয়েত ইউনিয়ন: ভারতের পর আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সবচেয়ে বড় মিত্রশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয় সোভিয়েত ইউনিয়ন। সোভিয়েতের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করলে তার প্রতিপক্ষ আমেরিকা ও চীনকে হীনবল করা সম্ভব হবে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতকে আশ্বাস দেয় যে, যুক্তরাষ্ট্র বা চীন যুদ্ধে সম্পৃক্ত হলে তারা এর বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে রাশিয়া সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহন করে। ২৫ মার্চ গণহত্যার পর প্রথম প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল ভারত। দ্বিতীয়টি সোভিয়েত ইউনিয়ন। সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ভূমিকা রেখেছিল।
৩. অন্যান্য মিত্র দেশসমূহ: মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বন্ধুর ভূমিকা পালন করে যুক্তরাজ্য। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্যরা জোরালোভাবে বাঙালির স্বাধীনতার লড়াইকে সমর্থন জানান। শরণার্থীদের জন্য অর্থ ও ত্রাণ সহায়তা দেয়। একাত্তরের গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাক্রম সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে জানাতে যুক্তরাজ্যের গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
তবে শুধু বিভিন্ন রাষ্ট্রই না, অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিই মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন। এঁদের মধ্যে আছেন সঙ্গীত শিল্পী, গায়ক এবং বেশ কয়েকজন সাংবাদিক—যাঁরা বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশের পক্ষ জনমত গড়তে সক্ষম হন। নিচে এঁদের সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:
১। পণ্ডিত রবিশঙ্কর রায় ও জর্জ হ্যারিসন: ভারতের নাগরিক পণ্ডিত রবিশংকর এবং মার্কিন নাগরিক জর্জ হ্যারিসন উভয় ছিলেন সঙ্গীত শিল্পী। ১৯৭১ সালে পণ্ডিত রবিশংকর জর্জ হ্যারিসনকে বাংলাদেশের চলমান মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে অবহিত করেন এবং বাংলাদেশকে অর্থ দিয়ে সাহায্যের জন্য একটি কনসার্ট আয়োজনের প্রস্তাব দেন। রবিশঙ্করের প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে হ্যারিসন ১লা আগষ্ট ১৯৭১ সালে নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ' নামে একটি কনসার্টের আয়োজন করেন। এই কনসার্টে পণ্ডিত রবিশংকর ও আলী আকবর খান সেতার পরিবেশন করেন এবং জর্জ হ্যারিসন পরিবেশন করেন বাংলাদেশের জনগণকে নিয়ে তার নিজের লেখা সেই বিখ্যাত গান—
'My friend came to me
With sadness in his eyes
Told me that he wanted hel
Before his country dies'
উক্ত কনসার্ট থেকে সেদিন প্রায় আড়াই মিলিয়ন মার্কিন ডলার বাংলাদেশকে সাহায্য করার জন্য সংগ্রহ করা হয়েছিল। যা পরবর্তীতে বাংলাদেশের জনগণের কাছে পাঠানো হয়।
২। সাইমন ড্রিং: ১৯৭১ সালে ইউকে'র দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফের প্রতিবেদক সাইমন ড্রিং ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ প্রত্যক্ষ করেন। সেই সময় পূর্ব পাকিস্তানের উত্তাল পরিস্থিতি নিয়ে একের পর এক রিপোর্ট পাঠান টেলিগ্রাফ পত্রিকায়। ২৫ মার্চ গণহত্যার পর সামরিক জান্তা যখন বিদেশি সাংবাদিকদের দেশে ফেরত পাঠায়, তখন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ২৭ মার্চ সকালে সাইমন ড্রিং ঘুরে দেখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল, রাজারবাগ পুলিশ ব্যারাক ও পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকা এবং লিখে ফেলেন ঢাকায় দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর চালানো প্রথম দফার গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের প্রত্যক্ষ চিত্র ‘ট্যাংকস ক্র্যাশ রিভল্ট ইন পাকিস্তান' ।
৩। মার্ক টালি: একাত্তরে মার্ক টালি বিবিসির দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সংবাদদাতা ছিলেন। যুদ্ধের দিনগুলোতে রেডিওতে তাঁর কণ্ঠ হয়ে উঠেছিল মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা। মার্ক টালি সীমান্তবর্তী বিভিন্ন শরণার্থী শিবির ও জেলাগুলো ঘুরে বাঙালির দুর্দশা ও যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির খবর পাঠাতে থাকেন বিবিসির হেড কোয়ার্টারে। ২৫ মার্চের বর্বর হত্যাযজ্ঞও তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন ঢাকায় বসে।
৪। সিডনি শানবার্গ: নিউইয়র্ক টাইমসের দক্ষিণ এশীয় সংবাদদাতা ছিলেন সিডনি শনবার্গ। ২৫ মার্চের গণহত্যার খবর প্রচার করায় পাকিস্তানি সামরিকবাহিনী তাঁকে দেশ থেকে বহিষ্কার করে । শনবার্গ ২৮ মার্চ নিউইয়র্ক টাইমসে In Dacca, Troops use Artillery to halt revolt শিরোনামে পূর্ব পাকিস্তানে নিরীহ বাঙালির ওপর পাকিস্তানের সামরিকবাহিনীর বর্বরতা তুলে ধরেন।
এমনই অসংখ্য রাষ্ট্র ব্যক্তি মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকস্তানিদের দমন-নিপীড়নের তথ্য বিশ্বব্যপী প্রচার করেছেন। তাদের এই প্রচারণার ফলে বিশ্বজুড়ে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর বিপক্ষে শক্তিশালী জনমত তৈরি হয়। যা বাংলাদেশকে স্বাধীনতার দিকে আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে দেয়। আমরা মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা এসব রাষ্ট্র ও ব্যক্তিদের কখনোই ভুলব না।